আমি অভিযোগ উত্থাপন করছি

>মুক্তিযুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যার বিচারের জন্য জানুয়ারি ১৯৯২–এ শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ–আদালত বসে। সেখানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গণহত্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মূল সহযোগী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করেন। ভূঁইয়া ইকবালের সৌজন্যে পাওয়া দুর্লভ এই দলিল প্রকাশ করা হলো।

মাননীয় আদালত

আমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অভিযোগ উত্থাপন করছি।

আমি অভিযোগ করছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে লাঞ্ছিত মায়েদের পক্ষে, আমি অভিযোগ করছি হানাদার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত বোনেদের পক্ষে, আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর আলবদর কর্তৃক নিহত বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি শত্রুর হাতে প্রাণদানকারী পিতা–মাতার অসহায় এতিম সন্তানদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষে।

আমি অভিযোগ আনছি মরহুম মওলানা গোলাম কবিরের পুত্র গোলাম আযমের বিরুদ্ধে—ইনি একজন পাকিস্তানি নাগরিক, বহুদিন ধরে বেআইনিভাবে বসবাস করে এসেছেন ঢাকার রমনা থানার মগবাজার এলাকার ১১৯ নম্বর কাজি অফিস লেনে।

ইনি সেই গোলাম আযম—যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতিটি অন্যায়, বেআইনি, অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজ প্রকাশ্যে সমর্থন করছিলেন, যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিয়ে তাঁদেরকে সমূলে ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, যিনি আলবদর বাহিনী গড়ে তুলে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করার প্ররোচনা দিয়েছিলেন—গোলাম আযমের প্ররোচনায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আছেন আমার শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সন্তোষকুমার ভট্টাচার্য ও সিরাজুদ্দীন হোসেন, আমার অগ্রজপ্রতিম শহীদুল্লা কায়সার, আমার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আহমদ, আমার সহকর্মী আবুল খায়ের, আনোয়ার পাশা, রাশীদুল হাসান ও মোহাম্মদ মোর্তজা, আমার ছাত্র আ ন ম গোলাম মোস্তফা ও সৈয়দ নজমুল হক—যাঁদের মৃত্যুতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত, শোকাহত ও ব্যথাতুর।

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আমার বিশেষ অভিযোগ—তিনি সর্বদা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন এবং এখনো করছেন; বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৮ সালের ১০ই জুলাই পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সশরীরে উপস্থিত থেকে, বক্তৃতা ও আলোচনার মাধ্যমে, স্মারকলিপি ও বিবৃতির দ্বারা, মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রচারপত্র ও প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে এবং সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করে নিজে এবং অপরের দ্বারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে দুর্বল ও সহায়হীন, বিচ্ছিন্ন ও বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছেন। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

আমার অভিযোগের সমর্থনে গোলাম আযমের কিছু কার্যকলাপের পরিচয় এখানে তুলে ধরছি।

(১) ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলে গোলাম আযম পাকিস্তানে বসে মাহমুদ আলী ও খাজা খয়েরউদ্দীনের মতো দেশদ্রোহীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নামে একটি সংগঠনের সূচনা করেন এবং বিভিন্ন দেশে পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার আয়োজন করেন। তিনি এই উদ্দেশ্যে দীর্ঘকাল পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির বলে নিজের পরিচয় দিতেন।

(২) ১৯৭২ সালে গোলাম আযম লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে আবার এই ভূখণ্ডকে পাকিস্তানের অংশে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেন। ১৯৭৩–এ ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস ইসলামিক সোসাইটিজের বার্ষিক সম্মেলনে এবং লেসটারে অনুষ্ঠিত ইউকে ইসলামিক কমিশনের বার্ষিক সভায় তিনি বাংলাদেশবিরোধী বক্তৃতা দেন। ১৯৭৪–এ মাহমুদ আলীসহ কয়েকজন পাকিস্তানিকে নিয়ে তিনি পূর্ব লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির এক বৈঠক করেন। বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে দেখে এই সভায় স্থির হয় যে তাঁরা এখন থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের আন্দোলন করবেন। এই সভায় গোলাম আযম ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশে ফিরে অভ্যন্তর থেকে ‘কাজ চালানোর’ প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেন। ১৯৭৭–এ লন্ডনের হোলি ট্রিনিটি চার্চ কলেজে অনুষ্ঠিত একটি সভায় তিনি এ কথারই পুনরাবৃত্তি করেন এবং সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশি ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আগমন করেন।

(৩) ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে গোলাম আযম রিয়াদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামি যুব সম্মেলনে যোগদান করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকল মুসলিম রাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি সাতবার সৌদি বাদশাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান এবং কখনো তিনি বাদশাহকে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে ও কখনো বাংলাদেশকে আর্থিক বা বৈষয়িক সাহায্য না দিতে অনুরোধ করেন। ১৯৭৪ সালে রাবেতায়ে আলমে ইসলামির উদ্যোগে মক্কায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এবং ১৯৭৭ সালে কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত একটি সভায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন।

(৪) অনুরূপভাবে গোলাম আযম ১৯৭৩ সালে বেনগাজিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য লবিং করেন। একই বছরে ত্রিপোলিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি যুব সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে হানিকর বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

(৫) ১৯৭৩ সালে গোলাম আযম মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা অ্যান্ড কানাডার বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানভুক্ত করার জন্য সকলকে কাজ করতে আহ্বান জানান।

(৬) ১৯৭৭ সালে গোলাম আযম ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ইসলামিক ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। ইনি সেই গোলাম আযম—যাঁকে ফেরার ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নিজ এলাকায় মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতে নির্দেশ দেন; ১৯৭৩ সালের ১৮ই এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনবলে বাংলাদেশ সরকার যাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে দেন, যিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও তিন মাসের ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১১ই জুলাই বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হবার পর যিনি বেআইনিভাবে এ দেশে রয়ে যান, ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেও যিনি নাগরিকত্ব ফেরত পাননি; বাংলাদেশ সরকার যাঁকে ১৯৮৮ সালের ২০শে এপ্রিলের মধ্যে দেশত্যাগের নির্দেশ দিলেও যিনি বাংলাদেশে থেকে যান; যাঁর নাগরিকত্ব ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা বাংলাদেশ সরকারের নেই বলে ১৯৮৮ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছেন, সেই গোলাম আযমের উপযুক্ত শাস্তিবিধানের জন্য এই গণ–আদালতের কাছে আমি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করলাম।