ভয়ের সময়ে আশার পথ দেখাও

টিম কুক
টিম কুক
>কথা ছিল নানা রঙের গাউন পরে হাজির হবেন শিক্ষার্থীরা। সমাবর্তনের টুপি উড়িয়ে তাঁরা হইহই করবেন, সেলফি তুলবেন। কিন্তু এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস বদলে দিল সব। ৩ মে, যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে খোলা মাঠে, ফাঁকা গ্যালারির সামনে। উপস্থিত ছিলেন অল্প কজন শিক্ষক। তবে পুরো অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছে ইউটিউবে, যা ঘরে বসে উপভোগ করেছেন প্রায় ১৩ হাজার স্নাতক ও তাঁদের পরিবার। এই ভার্চ্যুয়াল সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তা ছিলেন অ্যাপল কম্পিউটার ইনকরপোরেটডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিম কুক। ভিডিও বার্তায় শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি।

ভবিষ্যতে চোখ রাখার আগে, আমরা বরং একবার অতীত থেকে ঘুরে আসি।

১৯১৮ সালের শুরুর দিকের কথা। মার্কিন নৌবাহিনীর একজন তরুণ অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, মাত্র ৩৬ বছর বয়স। যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ দল ইউরোপের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত কি না, তা নিশ্চিত করতে ইউরোপের পথে পা বাড়িয়েছিলেন তিনি।

একজন ব্যতিক্রম কবি ও শিক্ষাবিদ, বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অনেক স্বপ্নভঙ্গের পর একই সঙ্গে শিক্ষকতা ও ব্যাংকের চাকরি করে জীবনে একটু থিতু হতে চেষ্টা করছিলেন তিনি।

একজন তরুণ নার্স, বয়স ২০। টরন্টোর একটি সামরিক হাসপাতালে আহত সৈনিকদের সেবা–শুশ্রূষা করতেন। বিশ্রাম নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ যুদ্ধের ক্ষত শুকানোর আগেই কী যেন এক অদ্ভুত রোগ তখন জানান দিতে শুরু করেছিল।

স্প্যানিশ ফ্লু যখন ধীরে ধীরে তাঁদের দেশ, জনগোষ্ঠী এবং শরীরে আঘাত হানল, তাঁরা তখনো জানতেন না, এই অসুখ তাঁদের জীবনকেও আমূল পাল্টে দেবে।

ফ্র্যাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্টকে একটি স্ট্রেচারে করে নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে নামানো হয়েছিল। নিউইয়র্কে ফিরে সুস্থ হওয়ার পর তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত হন। জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের পাশাপাশি ইতিহাসও বদলে দিয়েছিলেন তিনি।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে টি এস এলিয়ট লিখতে শুরু করেছিলেন তাঁর অনবদ্য কবিতা, ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’। ‘এপ্রিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাস’ দিয়ে শুরু হওয়া এই কবিতাই আধুনিক সাহিত্যের এক বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল, সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন এলিয়ট।

আর কোনো এক রোগীর কাছ থেকে স্প্যানিশ ফ্লু যখন অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্টের শরীরেও সংক্রমিত হলো, সেরে উঠতে অন্য অনেকের চেয়ে তাঁকে বেশি কষ্ট করতে হয়েছিল। কোয়ারেন্টিন ও সামাজিক দূরত্বের দীর্ঘ, ক্লান্তিকর সময়টাতে আকাশে বিমানের ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে তিনি ভাবছিলেন, পেশাটা বদলে ফেললে কেমন হয়! (অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্টই প্রথম নারী বৈমানিক, যিনি একা বিমান উড়িয়ে আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন—বি.স.)।

স্নাতকেরা, আমি দুঃখিত যে আজ তোমাদের সঙ্গে এক হয়ে দিনটা উদ্‌যাপন করতে পারছি না। নিজেই ফ্রেমের ভেতরে থাকলে পুরো ছবিটা দেখা খুব কঠিন। তবু আশা করব, এই অস্বাভাবিক সময়কেও তোমরা হৃদয়ে ধারণ করে রাখবে। সব বয়সেই জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমিই আমার গল্পের একমাত্র লেখক নই। চাই বা না চাই, আরও এক কঠিন ও স্বার্থপর ‘লেখকের’ সঙ্গে আমাদের এই গল্পের কৃতিত্ব ভাগাভাগি করে নিতেই হবে, তার নাম ‘পরিস্থিতি’।

যখন আমাদের চমকপ্রদ পরিকল্পনাগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, প্রিয় স্বপ্নগুলো ভঙ্গ হয়, যা অস্বাভাবিক নয়; তখন আমাদের সামনে দুটো পথ থাকে। হয় আমরা যা কখনোই পাওয়ার কথা ছিল না, তা হারানোর জন্য শোক করতে পারি। নয়তো এই প্রবল ঝাঁকির জন্য কৃতজ্ঞ বোধ করতে পারি। যে ঝাঁকি না খেলে কখনোই নিজের গল্পটা থেকে মাথা তুলে দেখা হতো না, আমরা একটা নতুন পৃথিবীর দিকে এগোচ্ছি।

১৯৯৮ সালে যখন অ্যাপলে যোগ দিই, নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার পেশাগত জীবনের বাকিটা স্টিভ জবসের সঙ্গে কাজ করে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই ভাগ্যই যেন চোরের মতো পা টিপে হাজির হলো। স্টিভ চলে যাওয়ার পর আমি যে একাকিত্ব বোধ করেছি, তাতেই প্রমাণ হয়, আমাদের ওপর অন্যের প্রভাবের চেয়ে শাশ্বত, শক্তিশালী আর কিছুই নেই।

হৃদয় দিয়ে মনে রেখো; এই সময়টা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, জীবনে সত্যিকার অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ কী? নিজের ও ভালোবাসার মানুষদের সুস্বাস্থ্য, একটি জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধক্ষমতা এবং চিকিৎসক থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ত্যাগ, যাঁরা অন্যের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন।

ঘর থেকে বেরোতে না পারার কারণে আমরা যেন সময়ের শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে পারছি না। আমি বই পড়ে সময়টা কাজে লাগাতে চেষ্টা করছি, এবং বারবারই ফিরে যাচ্ছি আব্রাহাম লিংকনের কাছে। লিংকন যখন তাঁর দেশকে পুড়তে দেখেছেন, তিনি আগুনের ভেতরের পথটাই বেছে নিয়েছেন।

‘নিরুপদ্রব অতীতের মতবাদ, ঝোড়ো বর্তমানের জন্য প্রযোজ্য নয়,’ তিনি বলেন। ‘বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের সামনে বাধার স্তূপ গড়ে দিয়েছে, এখন আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। যেহেতু পরিস্থিতিটা আমাদের জন্য নতুন, আমাদের নতুন কিছু ভাবতে হবে, নতুন কিছু করতে হবে। এখন আমাদের ভাবনার জড়তা থেকে বেরোতে হবে, দেশকে বাঁচাতে হবে।’

স্নাতকেরা, তোমাদের সমস্যাটাও নতুন। তোমাদের জন্য তো অতীতের মতবাদ কখনোই প্রযোজ্য ছিল না। কেবল অনুসরণ করার বিলাসিতা তোমাদের জন্য নয়। খোলা চোখে তোমরা এমন এক কঠিন পৃথিবীতে পা বাড়িয়েছে, যেখানে তোমার গল্প তোমার মনমতো লেখা হবে না, কিন্তু গল্পটা তোমারই।

নতুন কিছু ভাবো, নতুন কিছু করো।

তুমি যে ভবিষ্যৎটাকে সুনিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছিলে, তার চেয়ে আরও ভালো একটা ভবিষ্যৎ গড়ো। এই ভয়ের সময়টাতে আমাদের আশার পথ দেখাও।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ

সূত্র: ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট