ভাইরাসে যাঁদের ভয় নেই

>দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার কার্যক্রম চলছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষার্থীরা যুক্ত আছেন এর সঙ্গে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা নিয়ে এ আয়োজন। গ্রন্থনা করেছেন মিসবাহ্ উদ্দিন
হুমায়রা হাবিব। ছবি: কবির হোসেন
হুমায়রা হাবিব। ছবি: কবির হোসেন

নতুন কিছু শেখার প্রেরণা জুগিয়েছে: হুমায়রা হাবিব
স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের বিভাগের একটি নোটিশ থেকে প্রথম জানতে পারি, করোনা পরীক্ষার জন্য স্বেচ্ছাসেবক নেওয়া হবে। মূলত অণুজীববিজ্ঞান (মাইক্রোবায়োলজি) বিভাগের থিসিসের শিক্ষার্থী হয়ে দেশের জন্য কাজ করার এটা একটা বড় সুযোগ বলে মনে করেছি। তাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ জেনেও স্বেচ্ছাসেবক হয়েছি। এ ছাড়া বিভাগের চেয়ারম্যান সাবিতা রেজওয়ানা রহমান ও ছাত্র উপদেষ্টা মিজানুর রহমান স্যারও সহায়তা করেছেন।

যে ল্যাবে আমরা কাজ করি, থাকা-খাওয়াও সেই একই ভবনে। আমার বাবা হাবীবুর রহমান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। আমার ছোট বোনও ফার্মেসি বিভাগে পড়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাবে কাজ করে রাত-দিন থাকা আমার কাছে পরিবারের মতোই মনে হয়। ড. লতিফুল বারী আমাদের ল্যাব ইনচার্জ। অনেক কিছু শিখছি, নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। ১১ মে থেকে কাজ শুরু করি। আমরা কয়েকটা ধাপে কাজ করছি। প্রথম ধাপে এক সপ্তাহ ৪ জন কাজ করছি। এরপর আমরা হোম কোয়ারেন্টিনে যাব। তখন আরেকটি দল কাজ করবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে কাজ হবে। দিনের কাজ শেষে সামাজিক দূরত্ব মেনে আড্ডা দিই। সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা আছে জেনেও নতুন একটা বিষয় শেখার তীব্র ইচ্ছাও আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। পেশাদারত্ব বজায় রেখে দেশের জন্য যত দিন প্রয়োজন, কাজ করে যেতে চাই।

মো. সিরাজুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
মো. সিরাজুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

ভয়ের চেয়ে কাজের চাপ বেশি অনুভব করি: মো. সিরাজুল ইসলাম
স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী, প্যাথলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।

গত ২৫ মার্চ প্রথম আলোতে‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ল্যাব কেন ফেলে রাখা হচ্ছে’—এ রকম একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটা আমার খুব ভালো লাগে। আমি ফেসবুকে শেয়ার দিই। আমি আমাদের বিভাগের ল্যাবে দুই বছর ধরে কাজ করছি। আমাদের শিক্ষক জুনায়েদ সিদ্দিকী স্যার আমার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। কিছু উদ্যোগ নিলে আমরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে করোনা পরীক্ষা করতে পারি বলে একমত হই।

পরে জুনায়েদ স্যার আমাদের উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশ স্যারকে জানান। উপাচার্য স্যার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুমতি নেন। এরপর আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমি স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা। আমি আর জাহান আরা নামে আরেকজন ২৫ এপ্রিল থেকে টানা কাজ করছি। অন্যরা কিছুদিন কাজ করে আইসোলেশনে যায়। আমরা আর যাইনি।

বিশ্ববিদ্যালয়েই আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথম যখন মাকে বিষয়টি জানাই, মা বলেন, ‘তুমি আমার একমাত্র ছেলে। এত ঝুঁকিতে যাবা?’ তবে মাকে আমি বুঝিয়ে রাজি করাই। অবশ্য আমার থিসিস তত্ত্বাবধায়ক ও িবভাগীয় প্রধান ড. শারমিন চৌধুরী উৎসাহিত করেছেন, মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। এখন ভয়ের চেয়ে কাজের চাপ বেশি অনুভব করি। সারাক্ষণ মনে হয়, আমরা ঠিকমতো কাজটা করতে পারছি তো? বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল ইনফেকশাস ডিজিজ (বিআইটিআইডি) থেকে নমুনা পাঠায়। আমরা দুইটা দলে ভাগ হয়ে কাজ করি। একটি দল নমুনা থেকে আরএনএ আলাদা করে। অন্য দল পিসিআরে কাজ করে। মূল কাজ করতে বেশি সময় লাগে না। তবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ করা একটু সময়সাপেক্ষ। দেশের জন্য কাজ করার এমন সুযোগ বারবার আসবে না, তাই ভালো লাগে।

হাবিবা ইবনাত। ছবি: সংগৃহীত
হাবিবা ইবনাত। ছবি: সংগৃহীত

ভাইরাস নিয়েই তো আমাদের কাজ: হাবিবা ইবনাত
স্বেচ্ছাসেবক, করোনা পরীক্ষাগার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করে আমাদের বিভাগের চেয়ারম্যান ইকবাল কবীর স্যারের একটি প্রকল্পে কাজ করছিলাম। বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের (বিএএস) অধীনে ওই প্রকল্পে গবেষণা সহকারী ছিলাম। তাই চেয়ারম্যান স্যারকে বলে রেখেছিলাম, স্বেচ্ছাসেবক নিলে আমাকে যেন নেন। স্যার আমার অনুরোধ রেখেছেন।

এখানে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে আমরা কাজ করি। আমাকে দ্বিতীয় ধাপে কাজ করতে দেওয়া হয়। ২৭ এপ্রিল প্রথম কাজ শুরু করি। ১০ দিন কাজ করার পর আমরা ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে যাই। আমি এখন হোম কোয়ারেন্টিনে আছি। এরপর আবার কাজ শুরু করব। আমার পালা ছিল রাতের বেলা। প্রথম দিকে একটু নার্ভাস ছিলাম। পরে অবশ্য মানিয়ে নিয়েছি। আমার সঙ্গে কাজ করা ওই দলে বিভাগের দুজন ম্যাডামও ছিলেন। আমি এর আগেও পাশের ল্যাবে প্রজেক্টের কাজ করেছি। তাই আলাদা কিছু মনে হয়নি। আসলে কাজ শুরু করলে রাত-দিন আর মাথায় থাকে না। পূর্ণ মনোযোগ থাকে কাজের প্রতি। আমার বিভাগের শিক্ষকেরা খুবই সহযোগিতা করেছেন। এমনকি এখন হোম কোয়ারেন্টিনে আসার পরও বিভাগের চেয়াম্যানসহ অন্য শিক্ষকেরা খোঁজখবর নিচ্ছেন। মা প্রথম দিকে একটু কান্নাকাটি করেছিল। এরপর অবশ্য বাসার সবার সহযোগিতা পেয়েছি। এ ধরনের ল্যাবে যেসব নিরাপত্তার বিষয় নিশ্চিত করে কাজ করতে হয়, তার অভিজ্ঞতা আমার ছিল। এই বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া নিয়েই তো আমাদের কাজ! তাই আমার কাছে নতুন কিছু মনে হয়নি। তবে ঝুঁকি এবার একটু বেশি ছিল।

তাহসিন মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত
তাহসিন মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত

ফাঁকা ক্যাম্পাসে এ এক অন্য অভিজ্ঞতা: তাহসিন মাহমুদ
অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের বিভাগের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্যার (যিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের করোনা পরীক্ষার কিট উদ্ভাবন দলের একজন সদস্য) ল্যাবে করোনা পরীক্ষার অনুমতি নেওয়ার পর স্বেচ্ছাসেবক নেওয়ার নোটিশ দিলেন। ভয় না পেয়ে নাম আমিও নাম লিখিয়ে ফেলি। প্রথম যখন নোয়াখালীর সিভিল সার্জন মমিনুর রহমান আমাদের বিভাগে আসেন, তখন ফিরোজ স্যার আমাদের যোদ্ধা বলে পরিচয় করিয়ে দেন। এতে আমরা আরও উৎসাহিত হই।

প্রথম যখন বাংলাদেশে ভাইরাস ধরা পড়ার কথা শুনছি, তখন থেকেই ইচ্ছা ছিল সুযোগ থাকলে এ বিষয়ে কিছু কাজ করব। স্নাতক শেষ করার আগেই দেশের জন্য কিছু করার এটা একটা বড় সুযোগ। আমাদের পড়ার বিষয়টাও করোনাভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।‍+ বাবা-মাকে জানিয়েছি, তাঁরা উৎসাহ দিয়েছেন। আইসিডিডিআরবি থেকে এসে যাঁরা আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তাঁরা বলছিলেন, আমাদেরও সংক্রমিত হওয়ার ৫০ শতাংশ আশঙ্কা আছে।

দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে বাবা-মা পরিবারকে ঝুঁকিতে ফেলা ঠিক হবে কি না, একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের হলে থাকার ও অতিথি ভবনে খাবার ব্যবস্থা করবে নিশ্চিত হওয়ার পর কাজ শুরু করি। রাতে ক্যাম্পাসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আড্ডা দিই, ফাঁকা ক্যাম্পাসে মুক্ত বাতাসে এ এক ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতা। আমাদের এখানে ৬ জন করে একেকটা গ্রুপে কাজ করি। চার দিন একটা গ্রুপ কাজ করে, পরের তিন দিন বিশ্রামে যায়। এভাবে আমরা পালাক্রমে কাজ করি। ঝুঁকি এড়াতে ল্যাবে পরিচ্ছন্নতাকর্মী আলাদা করে রাখা হয় না। আমরাই পরিচ্ছন্নতার কাজসহ ল্যাবের যাবতীয় কাজ করি।