সময়ের আগেই তোমাদের পরিণত হতে হবে : বারাক ওবামা

>সবাই এক হয়ে, ধুমধাম করে সমাবর্তন অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ নেই। কিন্তু ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’-যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সমাবর্তনও থেমে নেই। অনলাইনেই সমাবর্তনের আয়োজন হচ্ছে। ২০২০ সালে যাঁরা হাইস্কুল পেরোলেন, তাঁদের জন্য ১৭ মে একটি সমাবর্তন বক্তৃতা দিয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ভিডিওটি রয়েছে ওবামা ফাউন্ডেশনের ইউটিউব চ্যানেলে।
বারাক ওবামা
বারাক ওবামা

গ্র্যাজুয়েশন হলো জীবনের সেরা অর্জনের একটি। একেকজন একেক বাধা পেরিয়ে এই অর্জনের স্বাদ পায়। কেউ অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করে, কেউ মা-বাবাকে বেকারত্বে ভুগতে দেখে, কেউ আবার নানা বৈষম্য মোকাবিলা করে এ পর্যন্ত পৌঁছায়। বেড়ে ওঠার গতানুগতিক চাপের পাশাপাশি এখন নতুন করে যোগ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাড়তি চাপ, নানা ধরনের সহিংসতার খবর, আর জলবায়ু পরিবর্তনের অশনিসংকেত। এসবের মধ্য দিয়েও যখন তোমরা লক্ষ্যের কাছাকাছি এসে উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলে, তখনই একটা মহামারি এসে পুরো পৃথিবীকে ওলট-পালট করে দিল।

সমাবর্তনের অনুষ্ঠানে বসে লম্বা বক্তৃতা শোনার হাত থেকে অন্তত রেহাই পেয়েছ। আমার তো পুরো দিন বসে বসে বক্তৃতা শুনতে হয়েছিল। তার ওপর সমাবর্তনের টুপি সবাইকে মানায় না, বিশেষ করে যাদের কান আমার মতো বড়, তাদের। এই সংকট কেটে গেলে আবার তোমরা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার অনেক সময় পাবে। উদ্‌যাপনও করতে পারবে।

গ্র্যাজুয়েশন হলো পরিণত জীবনের দিকে পা বাড়ানোর প্রথম ধাপ। এই সময়েই আমরা নিজেদের জীবনের হাল ধরতে শুরু করি। আমরা ঠিক করি, কোন দিকে যাব, কোন পেশায় নিজেকে জড়াব। কার সঙ্গে নিজের জীবন গড়ব। কোন নীতি মেনে জীবনে এগিয়ে যাব। তবে বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এত কিছু ভাবতে গেলে ভয় লাগাটা খুব স্বাভাবিক।

এখন চাইলেও তুমি সাধারণ একটা কলেজে ভর্তি হওয়ার কাজটা স্বাভাবিকভাবে করতে পারবে না। পড়াশোনার পাশাপাশি তুমি যে কাজ করবে, সেটাও কঠিন হয়ে উঠেছে। অনেক অবস্থাসম্পন্ন পরিবারও অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। আর যে পরিবারগুলো আগে থেকেই দুদর্শায় ছিল, তাদের জীবন তো সবচেয়ে কঠিন সংকটে।

এসব বলার মানে হলো, তোমাদের আসলে সময়ের আগেই বড় হতে হবে, পরিণত হতে হবে। আগের সব প্রজন্মের চেয়ে তোমাদের হতে হবে আরও দায়িত্ববান। একটা মহামারি আমাদের সব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আর সমাজব্যবস্থার পরতে পরতে জমে থাকা সমস্যাগুলোকে ওপরে তুলে এনেছে। পুরোনো কায়দায় যে সমস্যার সমাধান হবে না, এ ব্যাপারে এখন তরুণপ্রজন্ম সজাগ। তরুণেরা বুঝতে শুরু করেছে, ধনী হয়ে এখন কোনো লাভ নেই, যদি আশপাশের সবাই দারিদ্র্য আর রোগে-শোকে ভোগে। আমাদের সমাজ আর গণতন্ত্র তখনই সক্রিয় রাখা যাবে, যখন আমরা শুধু নিজেদের কথা না ভেবে একে অন্যের জন্য ভাবব।

এই মহামারি আরেকটা তেতো সত্যের ওপর থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছে—বড় বলে যারা এত দিন সব নীতি নির্ধারণ করে এসেছে, এখন বোঝা যাচ্ছে, তাদের কাছে আদতে সব প্রশ্নের জবাব নেই। তাই পৃথিবীটাকে আবার সুস্থ করে তোলার জন্য তোমাদের হাতেই সব দায়িত্ব, এই তরুণ প্রজন্মের হাতে। যে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, এই পরিস্থিতিতে কেউ তোমাকে বলতে পারবে না, ‘এসব বোঝার বয়স তোমার হয়নি’ অথবা ‘তুমি কিছু জানো না, এটা এভাবেই করতে হয়’। কারণ, আমরা কখনো এমন অবস্থায় পড়িনি, তাই আমরা তরুণদের আর পুরোনো শিক্ষা দিয়ে বোঝাতে পারব না। অনিশ্চয়তায় সব পুরোনো ধারণাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

আমি এত কিছু বলছি, আমিও তো একজন বুড়ো মানুষ। এই তারুণ্যের শক্তি দিয়ে তোমরা কী কী করতে পারো, কী কী পারো না—আমি এখন এসব শেখাতে যাব না। শুধু তিনটি উপদেশ দিয়ে যাব।

প্রথমটি হলো, ভয় পেয়ো না। দাসত্ব, স্নায়ুযুদ্ধ, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মহামারি, খরা, সহিংসতা—এমন অনেক দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে আমরা গেছি। আর প্রতিবারই সংগ্রাম করে টিকেছি, আমরা আরও শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে এসেছি, সমৃদ্ধ হয়েছি। বেশির ভাগ সময় এসব দুর্যোগ জয়ের পেছনে ছিল তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ।

দ্বিতীয় উপদেশ, নিজের মন যেটা সায় দেয়, তা-ই করো। যা করতে ভালো লাগে, সহজ লাগে, মনের মতো লাগে, তা-ই করো। শিশুরা কিন্তু এভাবেই ভাবে। দুর্ভাগ্যবশত, অনেক বড় বড় প্রভাবশালী-ক্ষমতাধরেরা জটিল ভাবনা থেকে বেরোতে পারে না। তাই হয়তো আমাদের সমস্যাগুলোও মেটে না।

আমি আশা করব, সব জটিল জটিল তত্ত্ব বাদ দিয়ে তোমরা একেবারে মৌলিক আদর্শের চর্চা করবে। যেমন সততা, পরিশ্রম, দায়িত্বশীলতা, নিরপেক্ষতা, উদারতা, অন্যকে সম্মান দেখানো। হয়তো সব সময় সব নীতি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা যাবে না। চলতে গেলে অনেক ভুল করবে, আমরা সবাই করি। কিন্তু নিজের কাছে কখনো মিথ্যা বোলো না, সময় যতই কঠিন হোক না কেন। সমস্যার কারণ না হয়ে সমাধানের অবলম্বন হয়ে ওঠো।

আর সব শেষে, নিজের গণ্ডি গড়ে তোলো। একা কেউ সমাজ বদলাতে পারে না। এখন যখন সবাই নিজেকে নিয়ে চিন্তিত, তুমিও ভাবতে পারো, আপাতত শুধু নিজেকে আর নিজের পরিবার নিয়ে ভাবলেই চলবে। কিন্তু আমরা যদি সত্যিই আবার সুস্থ পৃথিবীটাকে ফেরত চাই, দুঃসময় শেষ করতে চাই, চাকরি-শিক্ষার সমান সুযোগ চাই, যদি পরিবেশকে রক্ষা করতে চাই, ভবিষ্যতের মহামারিকে আগেই রুখে দিতে চাই, তাহলে আমাদের ধর্ম, বর্ণ, জাতিনির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে ভাবতে হবে, এক হয়ে কাজ করতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান