লকডাউন: নারীর জন্য 'পৃথক ফল'

কোমরে শাড়ি গুঁজে রণরঙ্গিনীরূপে নারী। এক হাত কোমরে, আরেক হাতে ঝাড়ু। যাঁর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন, তিনি তৈজসপত্র ধোয়া অবস্থায় ‘গোবেচারা’ স্বামী ছাড়া কেউ নন। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে লকডাউনে ‘জনপ্রিয়’ সচিত্র কৌতুক এটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সয়লাব এই কৌতুকচিত্রে অনেকের বিশেষ করে পুরুষের আধিক্য ছিল বেশি। আরেকটি কৌতুক হলো লকডাউনে স্বামী বাসন-কোসন পরিষ্কার করে এমনই অভ্যস্ত হয়েছেন যে লকডাউন শেষে সস্ত্রীক রেস্তোরাঁয় খেয়ে সেখানকার বাসন-কোসনও ধুয়ে ফেলেছেন।

লকডাউনে অনেক পুরুষই সচেতনভাবে ঘরের কাজে হাত লাগিয়েছেন, সেসব ছবি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই পুরুষের স্ত্রী ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছেন যাতে অন্যরাও উৎসাহিত হন। তবে পুরুষের ঘরের কাজ করা নিয়ে ফেসবুকে যে হারে কৌতুক বা হাস্যরস তৈরি করা হয়েছে বাস্তবতা থেকে তা অনেকটাই ভিন্ন।

 এই লকডাউনে শ্রেণিভেদে পুরুষেরা হোম অফিস, বিশ্রাম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম–কেন্দ্রিক সুকুমারবৃত্তির চর্চায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলেও তার ধারেকাছেও থাকতে পারেননি নারীরা। হোম অফিসের পাশাপাশি গৃহকর্মী না থাকায় ঘরের কাজ, সন্তান পালন, পরিবারের বয়স্কদের দেখভাল সবই করতে হয়েছে নারীকে। কোনো কোনো পরিবারে এই দায়িত্বের হেরফেরে স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য কলহের জেরও টানতে হয়েছে নারীকে, যা গড়িয়েছে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন পর্যন্ত। এক লকডাউন নারী-পুরুষের জন্য হাজির হয়েছে পৃথক ফল নিয়ে।

‘ডিফিকাল্ট ওমেন: এ হিস্ট্রি অব ফেমিনিজম ইন ১১ ফাইটস’ বইয়ের লেখক ও সাংবাদিক হেলেন লুইসের ভাষায়, মহামারি নারী ও পুরুষের ওপর প্রভাব ফেলে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। করোনাভাইরাস নারী ও পুরুষের চলমান বৈষম্যকে প্রকটভাবে তুলে এনেছে। ‘দ্য আটলান্টিক’–এ ছাপা হওয়া ‘করোনাভাইরাস নারীবাদের জন্য দুর্যোগ’ শিরোনামের প্রবন্ধে হেলেন লুইস লিখেছেন, মানুষ হোম অফিস আর সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি নিয়ে উজ্জীবিত থাকার চেষ্টায় নাম নিচ্ছেন উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার আর আইজ্যাক নিউটনের। বলছেন, প্লেগে (১৬০৬ সাল) বিধ্বস্ত ইংল্যান্ডে তাঁরা দুজন নিজেদের অন্যতম সেরা কাজগুলো করেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় বলা যায়, তাঁদের দুজনের কারও সন্তান পালনের দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। ১৬০৬ সালের প্লেগে শেক্‌সপিয়ার ছিলেন একাকী লন্ডনে। আর স্ত্রী আর দুই মেয়ে ছিলেন দূরে ওয়ারউইকশায়ারে। আর নিউটন ওই সময় বিয়েই করেননি।

লকডাউনের ঝাপটায় চিড়েচ্যাপ্টা

লকডাউনের সময় বাড়িতে বাড়িতে কাজের ঝাপটার পুরোটাই গেছে বা যাচ্ছে নারীর ওপর দিয়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী আফসোস করে বললেন, ‘এমনিতেই ঘরের কাজগুলোর তত্ত্বাবধান করি আমি। লকডাউনের পর বাসার কাজের খণ্ডকালীন সহকারী বাড়ি চলে গেছে। আগে যেভাবে শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভাল করতাম, সেভাবেই করি। কিন্তু স্বামী সারা দিন ঘরে বসে আমার কাজের খুঁত ধরেন। একদিন শ্বশুরের খাবার দিতে দেরি করেছি এই অভিযোগ করলে আমিও নিজের মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাই। এ কথা সে কথায় দুজনের কলহ গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে।’

আরেক কর্মজীবী নারী জানালেন, তাঁর স্বামী হোম অফিস করছেন। বাসার কাজে তাঁর স্বামী সহায়তা করেন না, তা নয়। তবে তাঁকে ছেলেমেয়েদের সামলানো, পড়াশোনা করানো, রান্নাবান্না যত কিছু করতে হয়, তার ১০ শতাংশও স্বামীকে করতে হয় না। স্বামী অবসর সময়টুকু ফেসবুক লাইভ, কবিতার আসর, গল্প লেখা চ্যালেঞ্জের নানা কিছুতে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে ঘরের কাজ করতে করতেই দিন পার করে ফেলেন। এর ওপর আবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বাসায় আদা-লবঙ্গ পানি, চায়ের আয়োজন আর সবকিছু জীবাণুনাশক করার যে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলে, তার পুরো ঝাপটা তাঁর ওপর দিয়েই যায়।

 বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জরিপ বলছে, এই সময়ে ৯১ শতাংশ নারীর গৃহকর্ম এবং পরিবারের সদস্যদের যত্নের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। ৮৯ শতাংশ নারী বলেছেন, তাঁদের কোনো অবসরই নেই। কোভিড-১৯–এ লকডাউন পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে, স্কুল বন্ধ থাকায় বাড়িতে ছোট ভাইবোনের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে কিশোরীদের। অন্যদিকে জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেন গত ১৬ মে ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ র‍্যাপিড জেন্ডার অ্যানালাইসিস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে, জীবন রক্ষার প্রশ্নে কোভিড-১৯–এর অবরুদ্ধ পরিস্থিতি নারীর জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। লকডাউন নারী-পুরুষে বিরাজমান বৈষম্য অব্যাহত রেখে নারীর ভোগান্তি আরও বাড়িয়েছে। মহামারির সঙ্গে টিকে থাকার লড়াইয়ে তথ্য ও সম্পদসহ অন্যান্য বিষয়ে নারী ও পুরুষ এবং ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য আরও বেড়েছে।

ইউএন উইমেনের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জেন্ডার স্ট্যাটিকস ২০১৮–এর তথ্য উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, কোভিড-১৯–এর আগে বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীকে ৩ দশমিক ৪৩ গুণ বেশি বাড়িতে কাজ করতে হতো। স্কুল বন্ধ থাকায় এবং পুরো পরিবার এখন বাড়িতে অবস্থান করায় বাড়িতে নারীর কাজ আরও বেড়েছে। যে পরিবারে বয়স্ক ব্যক্তিরা আছেন, সেই পরিবারের নারীকে রান্নাবান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার পাশাপাশি বয়স্কদের সেবাযত্ন করতে আরও বেশি সময় দিতে হচ্ছে। অপর দিকে পুরুষেরা বয়স্কদের সেবাযত্নের ক্ষেত্রে আরও চাপ সৃষ্টি করছেন।

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এপ্রিল মাসের জরিপ বলছে, লকডাউনে পরিবারের সবাই সব সময় গৃহে থাকার কারণে নারীর ওপর নির্যাতনের মাত্রাও বেড়েছে। জরিপ বলছে, দেশের ২৭টি জেলায় ৪ হাজার ২৪৯ জন নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৭২ জন আগে কখনোই নির্যাতনের শিকার হননি। এ ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক শাহানা হুদা বলেন, ‘নারীর গৃহস্থালি ও সেবামূলক কাজ সমাজে এমনিতেই সম্পূর্ণ অস্বীকৃত। এমনকি ঘরে থেকে নারী যে অর্থনৈতিক কাজ করে তারও যথাযথ স্বীকৃতি নেই। অথচ মজুরিবিহীন কাজের প্রায় ৭৫ শতাংশই করে নারী। এই মহামারিতেও দেখা যাচ্ছে, গৃহবন্দী অবস্থায় নারীর ওপর রয়েছে বাড়তি কাজের বোঝা। বেড়েছে সহিংসতার মাত্রাও।’

 ব্র্যাকের জেন্ডার কর্মসূচির পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, সরকারি হিসাবেই স্বাভাবিক সময়ে ৮০ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর বাড়িতে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হন। এখন যখন আয়, স্বাস্থ্য, ভবিষ্যৎ—সবকিছু নিয়েই দুশ্চিন্তা বেড়েছে, পরিবারগুলোতে তখন নির্যাতনও বেড়েছে। এ সময়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া বা প্রতিবেশীর সাহায্য চাওয়ার সুযোগ কমে যাওয়ায় বিপদ আরও বেড়েছে।

কোভিড-১৯–এ নারীর অবস্থা নিয়ে ১১টি জেলায় পরিচালিত ব্র্যাকের এক জরিপে ৩২ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁদের পরিবার ও পাড়ায় কাজ হারিয়ে অথবা আয় কমে যাওয়ায় পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে। বাড়িতে বসে ফোন করে ১০৯ নম্বরে বা পুলিশের কাছে ৯৯৯ নম্বরে সহায়তা চাওয়া যেমন বিপজ্জনক অনেকের জন্য, তেমনি সারা দেশে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য মাত্র যে ৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র ছিল তা মার্চ মাস থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে সংক্রমণের ভয়ে। পুলিশ করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধসংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করে নারী নির্যাতন রোধে যথেষ্ট সক্রিয় থাকতে পারছে না। আদালত বন্ধ, কাজেই মামলা, গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। এমনকি মামলায় প্রয়োজনীয় মেডিকেল পরীক্ষা করাতেও অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। নারীদের এই সময়ে পরস্পরকে সহায়তার, সাহস, শক্তি জোগানোর বা যোগাযোগের সব উপায়ও বন্ধ হয়েছে। কাজেই নারীর ঘরের চাপ, মানসিক চাপ দুটোই বেড়েছে।

করণীয়

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে জেন্ডার বিষয়ে করণীয় তুলে ধরে ইউএন উইমেনের প্রতিবেদন বলছে, নারীনেত্রী, বিভিন্ন নারী নেটওয়ার্ক ও সংগঠনকে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নারী, কিশোর-কিশোরীসহ ঝুঁকিতে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সুরক্ষা ও ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। জেন্ডার বিষয়ে ক্ষতিকর ধ্যানধারণা ও কুসংস্কার, যা নারী ও কিশোরীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এমন বার্তা প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

নারীবাদী প্রশিক্ষণকেন্দ্র ‘প্রাগ্রসর’–এর নির্বাহী পরিচালক (সম্মানসূচক) ফওজিয়া খোন্দকার বলেন, ‘লকডাউনের সময় নারীর ওপর কাজের চাপ কেমন গেছে, তা আমরা যে কেউ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই উপলব্ধি করতে পারি। আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভাবনা থেকে বের হতে পারি না বলে নারীর ওপর এই বাড়তি কাজের চাপ অনেকে উপলব্ধি করতে পারছেন না। তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের এর চেয়েও বেশি চাপের মধ্যে পড়তে হয়েছে। তা ছাড়া, এই নারীদের অনেকের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। এর প্রভাবও নারীকেই বইতে হচ্ছে। আমাদের কয়েকটি এলাকা পর্যবেক্ষণের তথ্য বলছে, নির্যাতনের কারণে কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছেন।’

জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফওজিয়া খোন্দকারের মতে, এই সংকটের সময়টায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানো, যত্ন করা, কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। নারীর প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার মধ্য দিয়ে চলমান বৈষম্য কমানো সম্ভব।