কোভিড যুঝের সঙ্গী তাঁরা

নারায়ণগঞ্জ থেকে শাহজাহান মিয়া স্ত্রী বীথির সহায়তায় রাজধানীতে এসেছেন চিকিৎসার জন্য।  ছবি: আশরাফুল আলম
নারায়ণগঞ্জ থেকে শাহজাহান মিয়া স্ত্রী বীথির সহায়তায় রাজধানীতে এসেছেন চিকিৎসার জন্য। ছবি: আশরাফুল আলম

পশ্চিমা বিশ্বে ‘দ্য নিউ নরমাল’ শব্দের মানে হচ্ছে যা আগে ছিল অপরিচিত, কল্পনার বাইরে, সেটাই সময়ে স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত হয়ে ওঠা। জীবনের অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক আর চিকিৎসা সংকটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মানুষের এখন কী অসামান্য চেষ্টাই না চলছে! ‘খুব সমস্যা না হলে এখন হাসপাতালে আসবেন না’ এই ঘোষণা যখন দেন চিকিৎসকই, তখন রোগীর জন্য পরিবারের ওপর ভরসা করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। এটাকে এখন ‘স্বাভাবিক’ ধরে নিয়ে রোগীর সঙ্গে কোভিড-১৯ রণে নেমেছেন পরিবারের কিছু সদস্য। সাত-আট ঘণ্টা ঘুমের সময়টাকে কেটেছেঁটে কেউ চার ঘণ্টায় নামিয়েছেন, সংসারের যজ্ঞে নিজের জন্য নিংড়ে যতটুকু অবসর বের করতেন, সেটাও নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিয়ে সবটুকুই ঢালছেন প্রিয়জনের শুশ্রূষায়। পরিবারের এই কেয়ারগিভার বা শুশ্রূষাকারীদের জন্য পশ্চিমা বিশ্বে অনেক প্ল্যাটফর্ম থাকলেও বাংলাদেশে বিষয়টি আলোচনায় খুব কমই জায়গা পায়।

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা ফারাজানা সালাম করোনাভাইরাসের সঙ্গে ৩৫ দিনের লড়াইয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘প্রথমে বেশ ভয় পেয়েছিলাম। এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তাই সব সময় নিজেকে এটাই বলতাম, ওদের জন্য আমাকে সুস্থ থাকতেই হবে। তারপরই মানসিকভাবে শক্ত হয়ে যাই।’ ৯ মে তাঁর স্বামী সাংবাদিক দিপু সিকদার এবং ২১ মে ছেলে জাইয়াদ রহমান (১৪) এবং মেয়ে জুনাইনা রহমানের (৯) করেনাভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসে। চার সদস্যের ওই পরিবারে একমাত্র সুস্থ ছিলেন ফারজানা। গত ২ মে স্বামী অসুস্থতা বোধ করলে শুরু থেকেই তাঁকে পৃথক কক্ষে রেখে সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেন। ৬ জুন দুই সন্তানের নমুনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসার আগ পর্যন্ত একাই লড়াইটি চালিয়েছেন।

ফারজানা জানালেন, স্বামীর খাবারের কাপ, প্লেট, গ্লাস দুই সেট করে রেখেছিলেন। দরজার কাছে ডিটারজেন্ট দেওয়া গরম পানির হাঁড়ি রাখা থাকত। স্বামী খাওয়া শেষে বাসন-গ্লাস সেসবে চুবিয়ে রাখতেন। খাবার, আদা-লবঙ্গ-লেবু চা, গার্গল ও ভাপের জন্য গরম পানি দেওয়ার জন্য তিনি দিনে একবার রুমে ঢুকতেন মাস্ক ও গ্লাভস পরে। তবে নয় বছরের মেয়েকে আলাদা করতে পারেননি। মেয়ে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। পরে ছেলেরও হওয়ার পর দুজনকে বিছানায় রেখে তিনি মেঝেতে ঘুমাতেন।

পূর্ব বাসাবোর বাসিন্দা সাবেক ক্রিকেটার এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পেস বোলিং কোচ আশিকুর রহমান মজুমদারের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ১১ মে। চিকিৎসকের পরামর্শে ১২ মে তিনি কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৯ মে বাড়ি ফেরেন। বর্তমানে বাসায় ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে আছেন। আশিকুরের স্ত্রী শাহীনা আক্তার জানান, স্বামীর করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর সাড়ে নয় বছরের ছেলে প্রত্ন ও সাড়ে তিন বছরের মেয়ে প্রজ্ঞা সংক্রমিত হয় কি না, সে ভয়ও ছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ওয়াহিদুল হক এবং তাঁর স্ত্রী মাহবুবা লিপি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁদের ছেলে সামিনকে (৬) নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। ১৪ মে নারিন্দার বাসা থেকে রাত একটায় সামিনের ফুফু মুর্শেদা বেগমের স্বামী মাসুম আলী মোটরবাইকে করে সামিনকে নিয়ে এসে ওয়ারীতে সামিনের দাদি সাহানা বেগমের কাছে দিয়ে যান। সেখানে ১০ দিন থাকার পর সামিনকে নিয়ে আসা হয় টিকাটুলীতে ফুফু মুর্শেদার বাসায়।

মুর্শেদা বলেন, ‘পৌঁছে দিয়ে আসার কাজটি করতেন আমার স্বামী মাসুম। এ ছাড়া আমার কাকা, কাকার শ্যালক, ভাবির বোন তাঁরাও পালা করে খাবার পাঠিয়েছেন। ভাইয়ার বাসার বারান্দার গ্রিলের ছোট একটি খোলা অংশ থেকে ওঁরা দড়িতে বালতি বেঁধে নিচে ফেলতেন আর খাবারের বাটিগুলো বালতিতে দেওয়ার পর তাঁরা ওপর থেকে টেনে নিতেন। ওষুধপত্র, ফলমূল সব এভাবেই দেওয়া হতো। সামিনের সঙ্গে বাবা-মা দুজন ভিডিও কলে কথা বলতেন।’

কোভিড-১৯ রোগীদের শুশ্রূষাকারীদের সমানভাবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ওয়াহিদা সুলতানা। তিনি বলেছেন, রোগীর কক্ষে প্রবেশের আগে শুশ্রূষাকারীকে অবশ্যই মাস্ক, ফেসশিল্ড, ক্যাপ, গ্লাভস পরে যেতে হবে। রোগীর মুখে যেন মাস্ক থাকে। রোগীর সঙ্গে ছয় ফুট দূরত্ব রাখতে হবে। প্রতিবার শুশ্রূষাকারী যেন ওই কক্ষ থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেন। বাসন, পরিধেয় পোশাক রোগী যেন নিজেই পরিষ্কার করে ফেলেন। এতে শুশ্রূষাকারীর ঝুঁকি কমে যাবে। তবে বয়স্ক এবং চলাফেরা করতে পারেন না, এমন রোগীদের ক্ষেত্রে যেহেতু শুশ্রূষাকারীকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে, তাই তিনি যেন ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) পরে কক্ষে প্রবেশ করেন। অথবা কক্ষে যে পোশাক পরে ঢুকবেন, তা যেন পাল্টে ফেলেন এবং সেই পোশাক ২০ থেকে ২৫ মিনিট ডিটারজেন্টে ভিজিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলেন। শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের মাধ্যমে যেন অন্য কারও না ছড়ায়, এ জন্য মাকে বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে। ওয়াহিদা সুলতানা বলেছেন, রোগীর পাশাপাশি সুস্থ থাকার জন্য শুশ্রূষাকারীকেও ভিটামিন-সি ও আমিষজাতীয় খাবার খেতে হবে, উষ্ণ পানির গার্গল করতে হবে, গরম পানির ভাপ নিতে হবে।