করোনায় উপেক্ষিত নারীস্বাস্থ্য

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও স্ত্রীকে নিচতলা থেকে ছয়তলা, ছয়তলা থেকে আবার নিচতলা এবং নিচতলা থেকে আবার তিনতলায় পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো হুইলচেয়ার পাওয়া যায়নি। একটি শয্যার জন্য “ওয়ার্ডবয়” এক হাজার টাকা দাবি করে। ৫০০ টাকা দিলে শয্যা পাওয়া যায়। এরপর স্ত্রীকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। পরের দিন ভোরে তো মারাই গেল স্ত্রী।’

মৃত ফাতেমা আক্তারের স্বামী তৌহিদুল আনোয়ার কথাগুলো বলছিলেন। ফাতেমার তৃতীয় সন্তানের জন্ম হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ ছিল ১৮ জুন।

শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে ফাতেমাকে গত মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম নগরের মা ও শিশু হাসপাতালে নেওয়া হয়। সন্ধ্যার দিকে চিকিৎসক জানান, ফাতেমাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করতে হবে। কিন্তু হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি নেই। তৌহিদুল আনোয়ার বললেন, বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন। তবে সেখানেও চলে কালক্ষেপণ।

করোনাভাইরাসের বিস্তারে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল দশায় নারী-পুরুষনির্বিশেষেই এর শিকার হচ্ছেন। তবে নারীদের অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার এল ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট। সেখানে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় আগেরবারের চেয়ে বেড়েছে। তবে এর কাঙ্ক্ষিত ফল নারীদের কাছে পৌঁছাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা আছে।

অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, মাতৃস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা—এ দুটো বিষয় করোনাকালে বড় উপেক্ষিত থাকছে। বাজেটে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকার যে থোক বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে, সেখানে খাতগুলো আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে স্পষ্ট করে বলার পাশাপাশি মাতৃস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা—এ দুই বিষয়ে বরাদ্দ রাখা দরকার।

করোনা পরিস্থিতিতে দেশে গত ২৬ মার্চ থেকে ‘সাধারণ ছুটির’ আদলে লকডাউন শুরু হয়। এটি দফায় দফায় বাড়িয়ে শেষ হয় গত ৩০ মে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) গত ৬ মে এক প্রতিবেদনে বলেছে, এপ্রিল মাসে দেশে নতুন করে গর্ভধারণ করেছেন ২৪ লাখ নারী। সংস্থাটির আশঙ্কা, করোনাকালে জন্মকালীন পরিচর্যা এবং অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুর জীবন রক্ষার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পরে।

জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাড়িতে কাজের চাপ নারীকে সামলাতে হচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে যে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা মিলছে না, এর প্রভাব সবার ওপর পড়ছে। তবে নারীকে এর বড় ঝক্কি সামলাতে হচ্ছে। বাসায় কোভিড রোগী থাকলে নারীদের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকছে। আর নারী আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর যত্ন কে করবে, সেটা একটা বড় সমস্যা। অনেকের স্বামী প্রবাস থেকে দেশে ফিরেছেন। অনেকেই কাজকর্ম হারিয়ে বাড়িতে আছেন। তাঁরা পরিবার পরিকল্পনাসামগ্রী কতটুকু পাচ্ছেন, সেটা একটা প্রশ্ন। সামনে বড় সমস্যা হতে পারে নারীর প্রজননস্বাস্থ্য। এই লকডাউনে অনেকে গর্ভধারণ করেছেন। এখন এসব মায়ের প্রসবপূর্ব, প্রসবের সময় এবং পরবর্তী সময়ের যত্নের বিষয়গুলো চিন্তায় রাখতে হবে। হাসপাতালে কোভিড-১৯ ছাড়া অন্য রোগীদের পরিষেবা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আয় কমে যাওয়ার কারণে সৃষ্টি হবে অপুষ্টি সমস্যা। নিম্ন আয়ের পরিবারের মা ও শিশুর অপুষ্টির বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে। অপুষ্টি পঙ্গুত্ব থেকে শুরু করে আরও অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে। সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো যেন নজরে থাকে।

করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও চিকিৎসক রওশন আরা বেগম বলেন, ‘করোনাকালে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার জন্য আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। এটা তারা স্বীকারও করেছে। লোকবল, সামগ্রীর স্বল্পতাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা জানিয়েছে অধিদপ্তর।’

অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি রওশন আর বেগম বলেন, এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিষেবা কমায় আরও অতিরিক্ত ৩৮ শতাংশ প্রসব হচ্ছে বাড়িতে। এতে মাতৃমৃত্যু এবং অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকি বাড়ছে।

হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। গত ২৬ মে গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হলে এক নারী ওই হাসপাতালের প্রধান ফটকের পাশেই সন্তান প্রসব করেন। এ ছাড়া ভর্তি না করায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল চত্বরে ভ্যানের ওপর এক নারী সন্তানের জন্ম দেন গত ৪ মে।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতে গত ২৪ মে সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠান। তিনি হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। ১ জুন দেশের সব করোনা হাসপাতালে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনা পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির মধ্যে মাতৃস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক উপকমিটি আছে। এ উপকমিটি কয়েক দফা সুপারিশে গর্ভাবস্থায় মায়ের প্রথম তিন মাসে একবার, শেষ তিন মাসের মধ্যে করোনা টেস্ট করা এবং কোনো মা হাসপাতালে গেলে ফিরিয়ে না দেওয়ার কথা বলা হয়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র ফেলো নাজনীন আহমেদ বলেন,দেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তির হাতে সন্তান হওয়ার হার কম। অপরিপক্ব হাতে সন্তান হওয়ার জন্য নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সারা জীবনের জন্য এসব জটিলতাকে বয়ে বেড়াতে হয় নারীদের। আর আছে পুষ্টিহীনতা। নারীদের, বিশেষ করে কারখানায় কাজ করা নারীদের প্রস্রাবের সংক্রমণ অনেক বেশি। সমস্যা সমাধানে মালিকদের মনোযোগী হতে হবে। আর সবচেয়ে বেশি দরকার দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যবিমা। এ ক্ষেত্রে শ্রমিক-মালিক-সরকার মিলিয়ে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার কথা অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে। এখানে শ্রমিকদের বিমার অর্থ সরকার ভর্তুকি হিসেবে দিয়ে দিতে পারে। বাজেটে এই ভর্তুকির বিষয়টি রাখা উচিত। বিমাসুবিধা পুরুষ-নারী উভয়ের কাজে লাগবে। বাজেটের বরাদ্দ এ খাতগুলোয় সুনির্দিষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ জন্য অবকাঠামো ও ওষুধপথ্য—সবকিছুর ওপরই নজর দেওয়া দরকার।  

 নারী ও কিশোরীদের ওপর করোনাকালীন প্রভাব কেমন—এর ওপর এক সমীক্ষা করেছে ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি বিভাগ। ব্র্যাক ১১টি জেলায় তাদের কর্ম এলাকার ৫৫৭ জন নারী-পুরুষের ওপর এ জরিপ করে। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই নারী। দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ পুরুষ ও ৮৬ শতাংশ নারী করোনার জন্য সতর্কতামূলক বার্তা পেয়েছেন। কিন্তু সুরক্ষাসামগ্রীগুলো পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে পুরুষ অনেক এগিয়ে। ৭০ শতাংশ পুরুষ মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন। তবে নারীদের মধ্যে এ সংখ্যা ৩৫ শতাংশ। ২০ শতাংশ পুরুষ দস্তানা পরেন, নারীদের মধ্যে এ সংখ্যা মাত্র ১০।

ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি বিভাগের তৎকালীন পরিচালক আন্না মিনজের নেতৃত্বে গত ২৮ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল এ জরিপ চলে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনউইমেনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ নারী তাঁদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার সামগ্রীর অপ্রতুলতার কথা বলেছেন, বিশেষ করে নারীপ্রধান পরিবারের কাছে এ সমস্যা প্রকট। ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ: র‍্যাপিড জেন্ডার অ্যানালিসিস’ শিরোনামে ওই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে গত মে মাসে।

বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, লকডাউনে সারা বিশ্বে নারী নির্যাতন, বিশেষ করে পারিবারিক নারী নির্যাতন বেড়েছে। বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) গত এপ্রিল মাসে দেশের ২৭টি জেলায় নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপ অনুসারে ২৭টি জেলায় এপ্রিল মাসে ৪ হাজার ২৪৯ জন নারী এবং ৪৫৬টি শিশু নিজ ঘরেই সহিংসতার শিকার হয়েছে। এ ধরনের সহিংসতায় নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পড়ছে।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কিশোরী ও নারীদের মনঃসমাজতাত্ত্বিক সহযোগিতা দরকার। বাজেটে এ খাতে অর্থ বরাদ্দ সুনির্দিষ্ট করতে হবে।