করতালি দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তাঁরা

সুস্মিতা খানের পরিবারের সদস্যরা করতালি দিচ্ছেন।  ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
সুস্মিতা খানের পরিবারের সদস্যরা করতালি দিচ্ছেন। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

সামাজিক গবেষক সুস্মিতা খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ঠিক রাত নয়টায় বাসার বারান্দায় যান। ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ড সবাই একসঙ্গে করতালি দেন। তারপর যে যাঁর কাজে চলে যান। এভাবে পরিবারটি ৮২তম রাত পার করে ফেলেছে। করতালি দিয়ে করোনাভাইরাসকে কাবু করতে রাত-দিন পরিশ্রম করা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিক, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন পেশা–শ্রেণির মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন সুস্মিতা খানের পরিবারের সদস্যরা। ‘তালির শব্দে উজ্জীবিত হোক আমাদের থমকে যাওয়া জীবন’—এ স্লোগান সামনে রেখেই চলছে এ করতালি কার্যক্রম।

গত ২৮ মার্চ থেকে সুস্মিতা খান এ করতালি দেওয়া শুরু করেছিলেন। নিজের ভাবনার কথা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। ফেসবুকেই একটি ইভেন্ট পেজ খোলেন। একদম একা শুরু করলেও এখন এই করতালি কার্যক্রমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ যোগ দিচ্ছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়ের আতিকুল ইসলাম পরিবারের সদস্যদের নিয়ে করতালি কার্যক্রমে কয়েকবার অংশ নিয়েছেন, তার ভিডিও তিনি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন। এভাবেই করতালি দেওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

সুস্মিতা খান তাঁর শাশুড়ি মনোয়ারা বেগমের কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘মা বলেন, ৩০ সেকেন্ডের করতালিতে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা একজন যোদ্ধাও যদি খুশি হন, তাহলে এ কাজ আমরা কেন করব না।’

 রাজধানীর মহাখালীর ডিওএইচএসের দোতলা বাসাটিতে শাশুড়ি মনোয়ারা বেগম, চিকিৎসক ননাস অধ্যাপক নাহেলা বারী, নিজস্ব ফার্মে কর্মরত স্বামী শামস রশীদ এবং সুস্মিতা খান থাকেন। করতালি কার্যক্রমে বাসার সার্বক্ষণিক সহায়তাকারী গোলাপী, যে নিজেও টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তিনিও অংশ নেয় প্রতিদিন। শামস রশীদ করতালির ভিডিও করেন বলে এ কার্যক্রমে সরাসরি অংশ নিতে পারেন না।

সুস্মিতা খান বর্তমানে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে বাসায় আইসোলেশনে আছেন। তাই গত কয়েক দিনের ভিডিওতে তিনিও অনুপস্থিত। বললেন, ‘আমি না থাকলেও করতালি দেওয়া কিন্তু থেমে নেই। বাসার অন্য সদস্যরা ঠিকই হাজির হন বারান্দায়। সারা দেশের মানুষ যেমন বেলা আড়াইটার সময় টেলিভিশনে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া করোনার আপডেট জানতে উদ্‌গ্রীব থাকে, আমরাও প্রতিদিন রাত নয়টার অপেক্ষায় থাকি। মনে হয়, কাজ থেকে ফেরার সময় একজন করোনাযোদ্ধাও যদি এ করতালি শুনতে পেয়ে খুশি হন, সেটাই হবে অনেক বড় পাওয়া।’

সুস্মিতা খানের খোলা ইভেন্ট পেজের প্রথমেই বড় করে ইংরেজিতে ‘থ্যাংক ইউ’ লেখা। সেখানে প্রতিদিনের ভিডিও শেয়ার দিচ্ছেন করতালি দেওয়া মানুষ।

‘ছড়িয়ে দিই শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা’—৮০, ৮১, ৮৩, ৮৩...তম রাত এভাবেই চলছিল হিসাব–নিকাশ। যার যার বারান্দা, ছাদে দাঁড়িয়েই চলছে এ করতালি দেওয়া। 

সুস্মিতা খান বললেন, ‘গত ২৬ মার্চের পর থেকে সরকারের সাধারণ ছুটি, লকডাউন, সব মিলে ঘরে বসে অনেকেই কী করব, তাই ভেবে অস্থির হচ্ছি। অথচ আমার নিজের ননাস গাইনির চিকিৎসক, তাঁর কোনো ছুটি নেই। একইভাবে অন্য চিকিৎসক, পুলিশ, সাংবাদিক, হাসপাতালের আয়া, স্বেচ্ছাসেবক, ইন্টারনেটের গতি ঠিক রাখতে কর্মরত মানুষগুলো...দিন–রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমরা প্রায় প্রতিদিন করতালি দিচ্ছি এসব মানুষের জন্য। কাদের জন্য করতালি দেব, তা করতালি দেওয়ার আগে ঠিক করে নিই, সেভাবেই লিখি ও ভিডিও শেয়ার করি। আমি করোনাভাইরাসের বিস্তারের শুরুর দিকে চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে করতালি দেওয়া ইতালির কিছু ভিডিও দেখেছিলাম। সেই ভিডিওগুলো দেখেই মূলত ইচ্ছাটা জাগে। আমি জানি, আমার এ ধরনের পাগলামিতে সবাই সাড়া দেবে না, তারপরও এখন অনেকেই সাড়া দিচ্ছেন।’

সুস্মিতা খানের পেজেও লেখা আছে, ‘হয়তো আর কেউ করবে না আপনার এলাকাতে। হয়তো আপনি একাই থাকবেন ছাদে/বারান্দায়। তাও করুন।’

সুস্মিতা খান বললেন, ‘আমার ভাইয়ের আট বছর বয়সী বাচ্চা তার ৬৩ বছর বয়সী দাদাকে নিয়ে ঠিকই প্রতিদিন বারান্দায় গিয়ে করতালি দিচ্ছে। রাজধানীর মিরপুরে থাকা ভাইবোন কাজটি করছেন প্রতিনিয়ত। টঙ্গীর চার বছরের বাচ্চা জামা গায়ে দিয়ে তার মামাকে ডেকে আনে করতালি দেওয়ার জন্য। চাঁদপুরের এক ছেলে প্রতিদিনই একা দাঁড়িয়েই করতালি দেন। সাভার, বরিশালসহ বিভিন্ন জায়গার মানুষ ভিডিও শেয়ার করে জানান দিচ্ছেন তাঁদের উপস্থিতি।’