করোনাকালে বাড়ছে বাল্যবিবাহ

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন এক সপ্তাহে তিনটি বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দিয়েছে। চলতি জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসব বিয়ে ঠেকানো হয়। তিনটি বিয়েই হতে যাচ্ছিল উপজেলার মালিয়াট ইউনিয়নে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুবর্ণা রানী সাহা এসব বিয়ের বিষয়ে তাঁর ফোনে তথ্য পান। এরপর তিনি ঘটনাস্থলে পাঠান সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) ভূপালী সরকারকে। তিনি গিয়ে এসব বিয়ে ঠেকিয়ে দেন। সুবর্ণা সাহা বলেন, ‘লকডাউনের প্রথম দিকে বিয়ের হওয়ার প্রবণতা বেশি ছিল না। ঈদের পরই বিয়ের সংখ্যা বেড়ে গেছে।’

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের বিস্তারের এ সময় বাল্যবিবাহের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামীণ পরিবারগুলোতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা এ সময়টায় দেশে ফিরেছেন। সমাজ বাস্তবতায় প্রবাসে কাজ করা ছেলের ‘পাত্র’ হিসেবে চাহিদা বেশি। আর এই অবরুদ্ধ অবস্থায় বিয়ে দিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন অভিভাবকেরা। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এখন কম হচ্ছে। সেই সুযোগও কাজে লাগাচ্ছে কেউ কেউ। সমাজের দরিদ্র অনেক অভিভাবকই এ সময় মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছেন, এ সময়টায় মানুষের চলাফেরা কমে গেছে। তাই খুব বেশি মানুষকে আপ্যায়ন করতে হচ্ছে না। এতে তাদের খরচও কমে যাচ্ছে।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে, লকডাউনে ঘরের মধ্যে পরিচিত মানুষের মাধ্যমে মেয়ে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার বেশি হচ্ছে। এই দিকটাও বাল্যবিবাহ দেওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে অনেক ক্ষেত্রে। 

তবে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার কথা সরকারি স্তরে কিন্তু স্বীকার করা হচ্ছে না। সরকারি ভাষ্য, হয়তো বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে কিন্তু বেড়ে যে গেছে এর অকাট্য প্রমাণ নেই। যদিও মাঠপর্যায়ের গবেষণায় বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট।

বাল্যবিবাহ বাড়ছে

আন্তর্জাতিক সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল কুড়িগ্রাম জেলার বাল্যবিবাহের বিষয়টি নজরদারি করে। সংস্থার এক প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে জেলায় বাল্যবিবাহের সংখ্যা ছিল ৮ শতাংশ। এপ্রিলে এসে এটি ১ শতাংশ বেড়ে যায়। মে মাসে মোট বিয়ের ১১ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়। এই চার মাসে ধীরে ধীরে নিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা কমছে, বাড়ছে অনিবন্ধিত বিয়ে। আবার এ সময়ে বাল্যবিবাহ ঠেকানোর ঘটনা কমে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে যেখানে ১৪টি বিয়ে ঠেকানো হয়েছিল, মে মাসে সেখানে ঠেকানোর সংখ্যা মাত্র দুই।

২০১৭ সাল থেকে বিল্ডিং বেটার ফিউচার ফর গার্লস নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এ কাজ করছে প্ল্যান। প্রকল্পের আওতায় ৭৬টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ যুব ফোরাম গঠন করা হয়েছে। তরুণেরা সংগঠিত হয়ে একাধিক বিয়ে ঠেকিয়েছে। প্রকল্পে ইমাম ও ঘটকদের প্রশিক্ষণ এবং যেসব বাবা বিয়ে না দিয়ে মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন, তাঁদেরও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যুব ফোরামসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রশাসনিকভাবে সহযোগিতা করা হয়। তবে প্রকল্প ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম চৌধুরী বললেন, সামাজিক শক্তিগুলোর সহযোগিতায় বাল্যবিবাহ কমছিল। কিন্তু করোনার কারণে এই সামাজিক শক্তিগুলোর সক্ষমতা কমতে শুরু করে। যুব ফোরামের সদস্যরাও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিভিন্ন জায়গায় চলাচল করতে পারছে না। আবার করোনা নিয়ে বাস্তবিকভাবে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় পুলিশ বা প্রশাসনও সহযোগিতা করতে পারছে না। সব মিলে একধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। আর এ সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছেন অভিভাবকেরা।

■ ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, ৮৫ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়েছে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে। ৭১ শতাংশ হয়েছে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য। বাইরে থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়া ৬২ শতাংশ বিয়ের কারণ ছিল।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টোরাল প্রকল্প বাল্যবিবাহ সব ধরনের নারী নির্যাতন প্রতিরোধের বিষয়টি তদারক করছে। বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন এর প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন। বাল্যবিবাহ যে বাড়ছে না, সে প্রমাণ দিতে তিনি তিনটি তথ্যের উৎস তুলে ধরেন। আবুল হোসেন জানান, প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসকেরা বাল্যবিবাহ নজরদারি করছেন। একেবারে ইউনিয়ন থেকে উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে এই নজরদারি চলে। এসব ক্ষেত্র থেকে আসা তথ্যে দেখা যাচ্ছে না যে বাল্যবিবাহ বাড়ছে। সরকারের হেল্পলাইন নম্বরে (১০৯) আসা কলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে বটে, কিন্তু সেখানে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়েছে তা দেখা যায়নি। সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ। একজন যে আরেকজনের বাড়িতে যাবে, সেটা এখন বন্ধ হয়ে আছে। মানুষের মধ্যে ভীতি আছে আবার তাঁরা আনুষ্ঠানিকতাও করতে পারছেন না। তাই বিয়ের সংখ্যা বেড়ে গেছে, তা বলা শক্ত।

পত্রপত্রিকায় বাল্যবিবাহের ঘটনা–সংক্রান্ত প্রতিবেদন কম হচ্ছে বলেও দাবি করেন আবুল হোসেন।

কেন বাড়ছে বাল্যবিবাহ

বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি বিভাগ নারী ও কিশোরীদের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। ব্র্যাক ১১টি জেলায় তাদের কর্ম এলাকায় ৫৫৭ জন নারী-পুরুষের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে এ সমীক্ষা করে। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের ৭৫ শতাংশই নারী। ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি বিভাগের তৎকালীন পরিচালক আন্না মিনজের নেতৃত্বে এ জরিপ চলে। দেখা যায়, জরিপ এলাকায় বাল্যবিবাহ আগের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিবাহ দিয়ে দিয়েছেন বা চিন্তা করছেন এমন মা–বাবার ভাবনা হলো এই করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হতে পারে। এতে অর্থনৈতিক সংকট আরও দীর্ঘায়িত হবে, তাই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকলে দিয়ে দেওয়াই ভালো। বেশির ভাগ বাবা-মা এলাকায় বিদেশ থেকে আসা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে ইচ্ছুক। আর এ সময় তা পেয়েও যাচ্ছেন। আর বাল্যবিবাহ দিলেও এ সময় প্রশাসন তাতে বাধা দিতে পারবে না বলেও মনে করছেন তাঁরা। ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, ৮৫ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়েছে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে। ৭১ শতাংশ হয়েছে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য। বাইরে থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়া ৬২ শতাংশ বিয়ের কারণ ছিল। করোনা ঠেকাতে ব্যস্ত প্রশাসনের বিয়ে ঠেকানোর কড়াকড়িতে যে শৈথিল্য আছে, তা ব্র্যাকের গবেষণায় স্পষ্ট।

বিষয়টির দিকে আবুল হোসেনের বক্তব্য হলো, ‘এখন স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার প্রশাসন করোনাকে প্রাধান্য দিয়েছে। বাকি কার্যক্রমগুলো হয়তো প্রাধান্যের তালিকায় নিচের দিকে চলে গেছে। হয়তো নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহের সম্ভাবনাটা বেড়ে গেছে। কিন্তু বেড়েছে সেটা বলা কঠিন।’ 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হেল্পলাইনে আসা অভিযোগের বরাত দিয়ে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক (কর্মসূচি) নিনা গোস্বামী বলেন, ‘জোর করে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে। আর আমাদের সহযোগী সংগঠনগুলো জানিয়েছে, প্রত্যন্ত এলাকায় বাল্যবিবাহ বেড়ে যাচ্ছে।’

আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন, বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ২১টি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে।

অথচ বাংলাদেশসহ বিশ্ব নেতারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধীনে ২০৩০ সালের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিবাহ নির্মূলের অঙ্গীকার করেছিলেন।