অন্য কামাল লোহানী

রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে (১৯৬১ সাল) শ্যামা নৃত্যনাট্যে কামাল লোহানী (বাঁয়ে), মন্দিরা ভট্টাচার্য (নন্দী) ও মৃণ্ময় দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত
রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে (১৯৬১ সাল) শ্যামা নৃত্যনাট্যে কামাল লোহানী (বাঁয়ে), মন্দিরা ভট্টাচার্য (নন্দী) ও মৃণ্ময় দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত

তিন–চার মাস ধরে প্রায় সবাই গৃহবন্দী। যোগাযোগের একমাত্র সূত্র হলো মুঠোফোন। তিন দিন ধরে খবর পাচ্ছিলাম, কামাল লোহানী অসুস্থ। আজ (গতকাল) সকালে খবর পেলাম, তিনি আর নেই।

কী যে এক মারণজ্বর এসেছে, একবার ধরলে আর নিস্তার নেই। লোহানীর সঙ্গে শেষ দেখা বোধ হয় ২০১৭–তে হয়েছে। আমারই আগ্রহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে, পঞ্চাশের দশকে ঢাকার সাংস্কৃতিক জীবন নিয়ে একটা ছোট্ট বক্তৃতা দিয়েছিলাম। বিভাগীয় অধ্যাপক সনিয়া আমিন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। মনে মনে খুবই উল্লসিত হয়েছিলাম পরিচিত নানা মুখের সমাবেশ দেখে। আমার পাশেই বসেছিলেন কামাল লোহানী। তা ছাড়া পরিচিত মুখের মধ্যে দেখলাম মুনতাসীর মামুন, রাহিজা (ঝুনু), কাজী মদিনা আর রোজী মজিদকে। কামাল লোহানীকে তখনো দেখলাম সটান বসে আছেন—পরনে সেই সাদা পায়জামা–পাঞ্জাবি। পরিবর্তন শুধু এক মাথা ধবধবে সাদা চুলে।

আমার বলার মূল প্রতিপাদ্য ছিল পুরান ঢাকায় নৃত্য–গীতচর্চা। বুলবুল একাডেমি ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সূচনায় আমি ও আমার দিদি ইন্দিরা, তাতে ভর্তি হয়েছিলাম। আমাদের নৃত্যশিক্ষক ছিলেন অজিত সান্ন্যাল। অল্পসংখ্যক ছাত্রী নিয়ে শুরু হলেও কিছুদিনের মধ্যে চার–পাঁচজন ছাত্রও ভর্তি হলো। তাদের মধ্যে ছিলেন অজিত দে, জেকব পিউরিফিকেশন, কামাল লোহানী, আলতামাস আহমেদ ও তখন ছোট্ট দুলাল তালুকদার। বুলবুল একাডেমির ক্লাস করতে করতে নানাজনের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছিল। তাদের মধ্যে গানের ছাত্র জাহেদুর রহিম ও আব্দুর রহিম চৌধুরী আর নাচের ক্লাসের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।

মন্দিরা ভট্টাচার্য (নন্দী)
মন্দিরা ভট্টাচার্য (নন্দী)

ইতিমধ্যে ছন্দপতনের মতো অজিতদা কলকাতায় চলে গেলেন। কিন্তু বুলবুল একাডেমি অন্য একজন নৃত্যশিক্ষক জোগাড় করে ফেলল। তার নাম গাজী আবদুল মান্নান। প্রথম প্রথম তিনি ছোটখাটো নৃত্যানুষ্ঠান করলেন। তারপর তিনি মস্ত বড় একটা পরিকল্পনা হাতে নিলেন। তিনি জসীমউদ্‌দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ–এর সফল রূপায়ণ করলেন। বুলবুল একাডেমির প্রায় সব বিভাগই এই নৃত্যনাট্যে অংশ নিয়েছিল। মূল ভূমিকায় মান্নান ভাই ও রাহিজা খানাম (ঝুনু) অসামান্য নৈপুণ্য দেখিয়েছিল। অনুষ্ঠানটি বহুবার হয়েছে। তার মধ্যে একটি কৌতুককর ঘটনা ঘটেছিল। নৃত্যনাট্যের কোনো একটি অংশে রায়বেঁশে নাচের ছন্দে ছেলেদের লাঠি খেলার দৃশ্য ছিল। কামাল লোহানী উত্তেজনার বশে তাঁর মোটা ফ্রেমের চশমা পরে মঞ্চে চলে গিয়েছিলেন। উইংসের ফাঁক দিয়ে ডাকতে মঞ্চ ছেড়ে ভেতরে গিয়ে চশমা খুলেছিলেন।

দেখতে দেখতে হইহই করতে করতে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী এসে গেল। আমার সবে আইএ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমরা ঠিক করলাম, রবীন্দ্রনাথের শ্যামা নৃত্যনাট্য করবই করব। পুরুষ চরিত্র নিয়ে ঝামেলা। কোথায় পাব এত নৃত্যশিল্পী। বজ্রসেন কে হবে—সবাই একবাক্যে বলল—কামাল লোহানী। লোহানী সাহেবকে বহু কষ্টে রাজি করিয়েছিলাম। যদিও শ্যামা আমাদের অপটু বিদ্যার ফসল, তখন কিন্তু খুবই সমাদর পেয়েছিল। বজ্রসেনের নৃত্যের কিঞ্চিৎ দুর্বলতা, তাঁর অপরূপ দেহসৌষ্ঠব সব পূরণ করে দিয়েছিল।

সত্যিই তো—মহেন্দ্র নিন্দিত কান্তি 

উন্নত দর্শন...।

মহড়ার সময় মাঝেমধ্যেই তাঁর পদচালনায় অসংগতি ধরা পড়ত। সেটা দেখিয়ে দিলে ভয়ানক চটে যেতেন—হয়তো যতটা আমার ওপর, তার চেয়ে বেশি নিজের ওপর। আমার মা এটা–সেটা বলে ঠান্ডা করতেন। শ্যামা ও বজ্রসেনের যুগল নৃত্য—

প্রেমের জোয়ারে,

ভাসাবে দোঁহারে… … …।

অনেক চর্চার পরে, শুনেছি খুবই মনোগ্রাহী হয়েছিল।

সব শেষে— 

ক্ষমিতে পারিলাম না যে

ক্ষম হে মম দীনতা… … …।

জাহেদুর রহিমের গানের সঙ্গে বেদনাকীর্ণ কামাল লোহানীর নৃত্যাভিনয় এত চমৎকার হয়েছিল যে আজও তা মনে করলে চোখে জল আসে।

পরবর্তীকালে তাঁর খ্যাতি ছিল সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ইত্যাদি। আমার কাছে আজও তিনি সেই অপরূপ বজ্রসেন।

মন্দিরা ভট্টাচার্য (নন্দী): গত শতকের পঞ্চাশ–ষাটের দশকে ঢাকার বিখ্যাত চিকিৎসক ও সমাজসেবী মন্মথনাথ নন্দীর দুই কন্যা ইন্দিরা নন্দী ও মন্দিরা নন্দী। মন্দিরার জন্ম ঢাকার বিক্রমপুরে। পড়াশোনা ঢাকার স্কুল ও কলেজে।

পরবর্তীকালে থিতু হন কলকাতায়। উচ্চতর শিক্ষালাভ প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব ও প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন।

প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৮ সালে প্রকাশ করেছে তাঁর স্মৃতিকথার বই ঢাকার স্মৃতি ও ডাক্তার নন্দী।