খোলামনে ভাবো কিসে তোমার আগ্রহ

গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাই সম্প্রতি অংশ নেন ইউটিউব আয়োজিত ‘ডিয়ার ক্লাস অব ২০২০’ নামের বিশেষ ভার্চ্যুয়াল সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। করোনা মহামারির এই সময়ে ঘরে থাকা তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অনুপ্রেরণাদায়ী কিছু কথা বলেছেন তিনি। ভিডিওটি ইউটিউব অরিজিনালসের চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে ৮ জুন।

কখনো ভাবিনি বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে এভাবে কোনো দর্শকের উপস্থিতি ছাড়া একদিন সমাবর্তন বক্তৃতা দেব। এখন খুব করে বুঝতে পারছি, আমাদের ইউটিউব ক্রিয়েটররা কিসের মধ্য দিয়ে যান! 

আমার মতো তোমরাও হয়তো এমন সমাবর্তনের কথা কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবোনি। যে সময়টায় তোমাদের উদ্​যাপন করার কথা, সে সময় এখন নানা কিছু হারানোর আক্ষেপে কাটছে—পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার আক্ষেপ, চাকরি না পাওয়ার আক্ষেপ, যে অভিজ্ঞতা অর্জনের কথা ভেবেছিলে, তা না পাওয়ার আক্ষেপ। এমন অপূর্ণতায় ভরা মুহূর্তে, আশার খোঁজ করা বেশ কঠিন। তাই আমি ওসব আশাজাগানিয়া কথায় না গিয়ে একবারে শেষ কথাটাই তোমাদের বলে দিই—জয় তোমাদেরই হবে।

বেশি খুশি হয়ে যেয়ো না। শেষ কথাটা বলে ফেললেও বক্তৃতা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি।

জয় তোমাদের হবেই—কথাটা বললাম এ কারণে যে এর আগেও অনেক প্রতিকূলতা ছাপিয়ে জয় ঠিকই এসেছে। ১০০ বছর আগে ১৯২০ সালের শিক্ষার্থীরাও ভয়ংকর এক মহামারির পর সমাবর্তন পেয়েছিল। ৫০ বছর আগে ১৯৭০ সালের শিক্ষার্থীরা একদিকে সমাবর্তন পেয়েছিল, অন্যদিকে চলছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। আর প্রায় ২০ বছর আগে, ২০০১-এর শিক্ষার্থীরা সমাবর্তন নেয় নয়–এগারোর মাসখানেক আগে। এই শিক্ষার্থীদের প্রত্যেককেই সমাবর্তনের পর নতুন নতুন প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তারা কিন্তু প্রতিবারই সব ছাপিয়ে জয়ী হয়েছে। 

তাই আশাবাদী হও। 

ছেলেবেলায় প্রযুক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আমার কল্পনার বাইরে। আমার বয়স যখন ১০ বছর, তখন বাড়িতে প্রথম টেলিফোন আসে। স্নাতক পড়তে যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগপর্যন্ত নিয়মিত কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। যখন বাড়িতে টেলিভিশন এল, তখন একটাই চ্যানেল দেখা যেত। তাই একবার আমার বিস্ময়ের কথা ভাবো, সেই আমিই আজ এমন এক প্ল্যাটফর্ম থেকে বক্তৃতা দিচ্ছি, যেখানে চ্যানেলের সংখ্যা কয়েক লাখ।

নিজের মতো করে পৃথিবীকে আরও উন্নত করে তোলো। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হলো নিজের ভালোবাসার জায়গাটা খুঁজে বের করা। যেমন আমার জন্য প্রযুক্তি ছিল ভালোবাসার জায়গা। তাই যখন পড়াশোনা শেষ করলাম, ঠিক করেছিলাম প্রযুক্তিকে আরও সহজলভ্য করার জন্য যা যা করা লাগে সব করব।

আমার বাবাকে তাঁর প্রায় পুরো বছরের বেতন খরচ করতে হয়েছিল আমার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্লেনের টিকিট কিনতে। তিনি এসব করেছিলেন যেন আমার স্ট্যানফোর্ডে পড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়। সেবারই জীবনে প্রথম উড়োজাহাজে উঠেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্র অনেক ব্যয়বহুল একটা দেশ ছিল আমার জন্য। বাড়িতে এক মিনিট ফোনে কথা বলার জন্য ২ ডলার লাগত, আর একটা ব্যাকপ্যাক কিনতে লাগত আমার বাবার পুরো ১ মাসের বেতন।

যুক্তরাষ্ট্র আসার পর থেকেই ভারতে থাকা আমার পরিবার, বন্ধু, আর আমার প্রেমিকা (যে এখন আমার স্ত্রী)—সবাইকে ভীষণ মিস করতে শুরু করি। স্ট্যানফোর্ডে কাটানো সেই একাকী মন খারাপ করা দিনগুলোয় আমার সঙ্গী হয়ে ওঠে কম্পিউটার। জীবনে প্রথমবারের মতো ওই সময়ে আমি নিজের ইচ্ছামতো যখন খুশি তখনই কম্পিউটার চালাতে পারতাম। তখনই ধীরে ধীরে আমার বিস্ময়ের জগৎটা বড় হতে থাকল। কাছাকাছি সময়েই ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা আমাকে আরও অস্থির করে তোলে। 

যে বছর আমি স্ট্যানফোর্ডে গেলাম, সে বছরই মোজাইক নামে একটি ব্রাউজার বাজারে আসে। সে সময় ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) আর ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর পেছনে এই ব্রাউজারের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। যে বছরের কথা আমি বলছি, সেই গ্রীষ্মেই স্ট্যানফোর্ড থেকে সদ্য পাস করা তরুণ সের্গেই ব্রিনের সঙ্গে প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র ল্যারি পেইজের পরিচয় হয়। পরবর্তী সময়ে এই দুই মুহূর্ত আমার জীবনকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়, যেটা আমি আমেরিকায় আমার শুরু দিকের একলা দিনগুলোতে ধারণাই করতে পারিনি। 

প্রযুক্তিকে সহজলভ্য করার জন্য ইন্টারনেটই যে একমাত্র পথ, এটা বুঝতে আমার কিছুটা সময় লেগেছিল। কিন্তু যখনই আমি এটা বুঝতে পেরেছি, তখনই আমার পড়ার জন্য নির্ধারিত কোর্স বদলে গুগলকেই আমার স্বপ্ন বানিয়ে ফেলি। প্রথম ব্রাউজারের বিস্ময় আমার ভেতর যে অস্থিরতার জন্ম দেয়, সেটা থেকেই ২০০৯ সালে তৈরি করি ক্রোম। এরপর গুগলের সঙ্গে এক হয়ে ল্যাপটপে ও ফোনে এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে লেগে পড়ি, যা বিশ্বের যেকোনো দেশের যেকোনো গ্রামে বা প্রত্যন্ত এলাকাতেও তথ্য ও প্রযুক্তিকে করবে সহজলভ্য।

যদি আমি শুরুর দিকে যে কোর্সে পড়ার জন্য স্ট্যানফোর্ডে এসেছিলাম সেটা নিয়েই পড়তাম, তাহলে হয়তো আজ আমার একটা পিএইচডি থাকত। আমার মা-বাবা হয়তো সেই পিএইচডির জন্য আমাকে নিয়ে ভীষণ গর্ব করতেন। কিন্তু প্রযুক্তির প্রতি আমার ভালোবাসার কারণে সেই সুযোগ ছেড়ে দিই। সবাইকে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি একটা সুযোগ হাতছাড়া করি। নয়তো আজ তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে গুগলের সিইও (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) হিসেবে বক্তৃতা দেওয়া হতো না। 

তাই তুমিও একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখো, কোন বিষয়টা তোমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে, আকর্ষিত করে। তোমার বাবা–মায়ের পছন্দ কোনটা বা তোমার বন্ধুরা কে কী করল, সমাজে এখন কোনটা বেশি গ্রহণযোগ্য, সেসব ভেবে বলো না। খোলামনে ভাবো তোমার আগ্রহের জায়গা কোনটা। 

জানি, আজ অনেক উপদেশ আর জ্ঞানের কথা শুনতে হচ্ছে তোমাদের। আমিও একটা বলি: নিজেকে মেলে ধরো, অস্থির হও, আশাবাদী হও। যদি এমনটা হতে পারো, ইতিহাস তোমাদের মনে রাখবে। এ জন্য না যে এ বছর তোমরা অনেক কিছু হারিয়েছ, মনে রাখবে কারণ, তোমরা একটা বদলের ডাক দিয়েছ। সব বদলে ফেলার সুবর্ণ সুযোগ আছে তোমাদের সামনে। আমি আশাবাদী, তোমরা পারবে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান