আনন্দ-বেদনার স্মৃতি

নাজমা আনোয়ার
নাজমা আনোয়ার

দেশের প্রথম নারী স্থপতিদের অন্যতম নাজমা আনোয়ার। ১৯৬২ সালে তৎকালীন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমানে বুয়েট) স্থাপত্য অনুষদের প্রথম ব্যাচে ভর্তি হওয়া তিনজন ছাত্রীর একজন তিনি। আজ ৮০ ছুঁইছুঁই বয়সে তিনি তাঁর স্মৃতিময় দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকিয়েছেন। এ নিয়েই লিখেছেন— নাজমা আনোয়ার।

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি যেসব স্মৃতির দিকে ফিরে তাকানোর সময় হয়নি, তারা আজ অভিমান ভরে আমাকে ছেড়ে যেতে বসেছে। খুঁটিনাটি অনেক কিছুই আজ আর মনে নেই। এখন সেই সময়ের কথা ভাবতে বসে মনে হচ্ছে কী সুন্দর, উজ্জ্বল-উচ্ছল, সৌরভময়, সুপ্রিয় ছিল দিনগুলো।

১৯৬২ সালে সেই সময়ের ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে ‘ফ্যাকাল্টি অব আর্কিটেকচার অ্যান্ড প্ল্যানিং’ বিভাগ খোলা হলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়টি বুয়েট নামে পরিচিতি লাভ করেছে। আর এই ফ্যাকাল্টিতে প্রথম তিনজন ছাত্রী ছিলাম ওয়াজেদা জাফর, শাহীন চৌধুরী ও আমি নাজমা হাবিব।

তখনকার ভাইস চ্যান্সেলর এস এ রশিদ, রেজিস্ট্রার এম এ জব্বার, স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ডিরেক্টর মো. কবির উদ্দিনসহ শিক্ষকেরা আমাদের স্নেহ করতেন। কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না জানতে চাইতেন। নারী বলে আমরা অবশ্য কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারতাম না। প্রথম সেমিস্টার থেকে দশম সেমিস্টার পর্যন্ত ওয়াজেদা জাফরই ছিলেন আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল।

এখন তো ইউনিভার্সিটি কত বড় হয়ে গেছে। সেই পুরোনো বিল্ডিংয়ের পেছনে বড় একটা এক্সটেনশন ব্লক ছিল। আর টিনের শেড ও বড় একটা হল নিয়ে ছিল আমাদের ফ্যাকাল্টি। একটা প্যাসেজের দুই মাথায় প্রাচীর তুলে আমাদের জন্য ছয় ফুট বাই বিশ ফুট একটা কমন রুম বানানো হলো।

মেয়ে বলে কোনো কাজে আমাদের মাফ ছিল না। সেই রায়ের বাজারের কুমোরপাড়ায় মডেল করার জন্য মাটি কিনতে গেছি, পুরান ঢাকার সিরাজউদ্দৌলা পার্কে গেছি পিসবোর্ড কিনতে, ল্যান্ড প্ল্যানিংয়ের অফিসে ধরনা দিয়েছি কোনো বিশেষ মৌজার নকশা সংগ্রহ করতে। আবার আমেরিকান এক্সপ্রেস বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠেছি বাংলাদেশ ব্যাংক বিল্ডিংয়ের ছবি আঁকতে। সময়মতো ক্লাসের কাজ জমা দেওয়ার জন্য কত রাত জাগতে হয়েছে। একসন্ধ্যায় বাসার বারান্দার টেবিলে ড্রয়িং শুরু করেছি, যখন শেষ হলো দেখি আকাশে লাল সূর্য উঠছে। ফ্যাকাল্টিতে অনেক সময় রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করেছি। আমাদের মায়েরা এসে ক্লাসের বাইরে অপেক্ষা করতেন। কার্পেনট্রি ক্লাসে করাত দিয়ে কাঠ কেটে বিভিন্ন রকম কাজ করতে হয়েছে। ব্ল্যাকস্মিথ ক্লাসে লোহা কাটা, ঝালাই করা, ড্রিলিং করা—এ সবই আমাদের করতে হয়েছে। শীতের দিনে সার্ভে ক্লাস শুরু হতো। সার্ভে যখন শেষ হলো তখন দেখা গেল আমাদের সবার মুখ ও হাতের খোলা অংশ রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। এভাবেই আমরা ১০টি সেমিস্টার পাড়ি দিয়ে ১৯৬৭ সালে স্থাপত্যে এ দেশে প্রথম গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হলাম।

পাস করে আধুনিক স্থাপত্যের পুরোধা মাজহারুল ইসলামের ‘বাস্তুকলাবিদ’-এ কিছুকাল কাজ করেছি। বিয়ের পর স্বামীর কর্মস্থল ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজেক্ট আর্কিটেক্ট হিসেবে যোগ দিই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্পোর্টস অ্যান্ড কালচারাল কমপ্লেক্স’ ও মেয়েদের ‘সুলতানা রাজিয়া হল’ আমার নকশায় নির্মিত হয়েছে। সংসারের ব্যস্ততায় পরে আর চাকরি করা হয়নি। আমি প্রায় ১৫টি সরকারি ও ব্যক্তিগত ভবনের নকশা করেছি। এগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গুলশানে আমার পৈতৃক ভবনের নকশা। বাইরের উন্মুক্ত দেয়ালগুলো করেছিলাম পুড়ে যাওয়া নীলচে ঝামা ইট দিয়ে। আর ইচ্ছেমতো কাজ করার স্বাধীনতা পেয়ে নানা রকমের নিরীক্ষা এখানে করেছিলাম।

প্রথম সেমিস্টারে আমাদের আর্কিটেকচারাল বিষয়গুলো পড়াতেন তিনজন আমেরিকান আর্কিটেক্ট। তাঁদের মধ্যে সি বুরম্যান ছিলেন আমাদের ফ্যাকাল্টির ডিন। ট্রেসিং পেপার, পেনসিল, রাবার, পেলিগাম, চায়নিজ ইঙ্ক, ব্রাশ—এসব কিনতে কতবার যে রয়্যাল স্টেশনারিতে যেতে হয়েছে।

মি. ওয়াল্ডেন আমাদের ডিজাইন ক্লাস নিতেন। মি. ডানহাম ও শিল্পী হামিদুর রহমান নিতেন বেসিক ডিজাইন ক্লাস। এই ক্লাসগুলো আমাদের কাছে খুব আকর্ষণীয় ছিল। মাঝেমধ্যে ডানহাম আমাদের বাইরে নিয়ে যেতেন বিশেষ বিল্ডিং দেখাতে ও তাঁর ছবি আঁকতে। হামিদুর রহমান স্যার একদিন আমাদের রমনা পার্কে নিয়ে গিয়ে বললেন, বিভিন্ন রকমের পাতার স্কেচ করতে হবে, এক মিনিটে একটা করে। নতুন নতুন পাতা খুঁজে বের করা আর স্কেচ করা। কী যে আনন্দ।

আমার সব কাজের উৎসাহদাতা আমার স্বামী সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন এবং ছাত্রজীবনের ঘনিষ্ঠ সহপাঠী ও বন্ধু রবিউল হোসেন ও অনুজ স্থপতি তাজু চৌধুরীকে হারানোর বেদনা আমি আজীবন বহন করব। বিগত দিন সত্যিই হারিয়ে যায়, তাকে আর ফেরত পাওয়া যায় না।