কীভাবে তুমি হয়ে উঠবে অপরিহার্য: অপরাহ উইনফ্রে

অপরাহ উইনফ্রে। ছবি: সংগৃহীত
অপরাহ উইনফ্রে। ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, অভিনেত্রী, সঞ্চালক ও বক্তা অপরাহ উইনফ্রে একটি ভার্চ্যুয়াল সমাবর্তনে বক্তৃতা করেছেন গত ১৬ মে। বক্তৃতাটি তাঁর ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম পেজ থেকে সম্প্রচারিত হয়েছে।

অবশ্যই এমন সমাবর্তন তোমরা কোনো দিন কল্পনা করোনি। নিশ্চয়ই তোমাদের গাউন পরে মঞ্চে ওঠার স্বপ্ন ছিল, ভেবেছিলে দর্শকের আসনে বসা পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের করতালির শব্দ শুনবে, উল্লাসে সমাবর্তনের টুপি বাতাসে ছুড়ে মারবে। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে যদিও কোনো উৎসব তোমাদের ঘিরে হচ্ছে না, কিন্তু তোমাদের মতো করে এত স্পষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, উদ্যম আর প্রত্যাশা নিয়ে কোনো প্রজন্ম সমাবর্তন পেয়েই ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ায়নি।

তোমাদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের জন্য কত বড় বড় ব্যক্তিত্ব জড়ো হয়েছে বিশ্ব ফেসবুক মঞ্চে! তাঁদের সঙ্গে আমিও শামিল হতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি, আর তোমাদের স্যালুট জানাচ্ছি। গ্র্যাজুয়েট শব্দটি এসেছে লাতিন ‘গ্র্যাডাস’ থেকে, যার অর্থ ‘কোনো কিছুর দিকে এক কদম এগোনো’। ১৫ শতকের শুরুর দিকে আলকেমি শাস্ত্রে ‘গ্র্যাজুয়েশন’ শব্দটি দিয়ে বোঝানো হতো মিশিয়ে ফেলা বা পরিশুদ্ধ করা। তোমরা আজ থেকে গ্র্যাজুয়েট, অর্থাৎ সামনে পা বাড়ানোর জন্য প্রস্তুত—যদিও সামনে কী আছে, জানা নেই! তোমাদের প্রত্যেকেই আজ সেই আলকেমি শাস্ত্রের গ্র্যাজুয়েটের মতো প্রস্তুত—নিজেকে যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার জন্য, নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য, আরও উন্নত করার জন্য। আমি বিশ্বাস করি, তোমরাই, অর্থাৎ আজকের এই গ্র্যাজুয়েটরাই আমাদের পথ দেখাবে।

‘আমি জানি সামনে তোমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে’—এটা বলার মতো ক্ষমতা যদি আমার থাকত, কত ভালো হতো! আফসোস, সেই ক্ষমতা আমার নেই। চারদিকে ভীষণ অনিশ্চয়তা। সত্যি বলতে, অনিশ্চয়তা সব সময়ই ছিল। তবে আমি আজ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি যে শ্রম, নিষ্ঠা আর মূল্যবোধ নিয়ে তোমরা আজ এই সমাবর্তনে পর্যন্ত পৌঁছেছ, ডিগ্রি অর্জন করেছ, ঠিক এই শ্রম, নিষ্ঠা আর মূল্যবোধই সব অনিশ্চয়তার মধ্যেও তোমাদের সঙ্গে থাকবে, তোমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। সামনে যা-ই আসুক না কেন, তোমাদের নিজস্বতা, তোমাদের সাহস, তোমাদের অনন্য করে তুলবে।

অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ানোয় একধরনের অস্বস্তি আছে। এই অস্বস্তিতেও শান্তির খোঁজ করা খুব জরুরি, এটা আমাদের সবার শিখতে হবে। সব প্রশ্নের উত্তর জানতেই হবে, এমন কথা নেই। উত্তর তোমার কাছে আসবেই, যখন তুমি অজ্ঞতাকে স্বীকার করে নেবে। নতুন কিছু জানার জন্য নিজেকে স্থির করো। চারপাশের শোরগোলে ডুবে তুমি যখন নিজের ভেতরের ডাক শুনতে পাবে না, তখন নিজেকে স্থির করে নিজেকে জানার চেষ্টা করো।

সমাবর্তন পাওয়া তরুণদের উদ্দেশে বলতে চাই, আমরা তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছি। পুরোনোকে জুড়ে আবার নতুন কিছু তৈরি করা শিখিয়ো না। আমাদের শেখাও নতুন করে কীভাবে আরও সুন্দর, পরিপূর্ণ, সহনশীল, সৃজনশীল আর মানবিক পৃথিবী গড়তে হয়। তোমরা দেখিয়ে দাও। 

এখন তোমাদের হাতে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা, লড়াই করার ক্ষমতা। এই সময়টা তোমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে নিজের এত দিনের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের অসমতা, অন্যায় আর অসুস্থতাকে সারিয়ে তোলার জন্য। সেই পড়াশোনা কাজে লাগানোর সময় এসে গেছে, যা তোমরা এত দিন মগজে ঢুকিয়েছ আর মন দিয়ে উপলব্ধি করেছ।

বর্তমান সময়ে আমরা মার্টিন লুথার কিংয়ের একটি উক্তিতে ফিরে যেতে পারি। বেশ কয়েক দশক আগেই তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, ‘আমরা প্রত্যেকে এক অপরিহার্য সমঝোতার জালে জড়িয়ে আছি, যার প্রতিটি সুতো একটি আরেকটির সঙ্গে জুড়ে আছে।’ তাই তো তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যক্ষভাবে যা একজনের জীবনে প্রভাব ফেলে, তা পরোক্ষভাবে সবাইকেই প্রভাবিত করে।’

মানবিকতা যদি একটা শরীর হয়, তাহলে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণ সেই শরীরের একেকটা কোষ। আর এখন আমরা সেই শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য এক ভীষণ কঠিন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি। এমন চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে আর কখনো আসেনি। তাই এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমাদের নিজেদেরও শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ-সবল থাকতে হবে, আমাদের সত্তাকে রাখতে হবে স্বচ্ছ ও দৃঢ়। 

প্রশ্ন করতে পারো, কতটা দৃঢ় আর সবল হতে হবে আমাদের? এর স্পষ্ট ধারণা পাবে এ সময়ে অপরিহার্য কাজের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের দেখলে। শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, মুদির দোকানে কাজ করা কর্মী, ট্রাকচালক, খাবার সরবরাহকারী, যাঁরা যত্ন নিচ্ছেন আমাদের বৃদ্ধ দাদা-দাদিদের, যাঁরা প্রতিদিন ময়লা-আবর্জনা নিতে আসছেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা—তাঁদের দেখে এত দিনে আমরা বুঝতে পারছি আদতে সমাজের অপরিহার্য শক্তি কারা। আজ আমরা সবাই সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় ঘরে থাকতে পারছি। কারণ, তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের প্রয়োজন আর চাহিদা মেটাচ্ছেন। এভাবেই তাঁরা আমাদের জন্য, সমাজের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন।

তুমি কীভাবে নিজেকে সমাজের জন্য অপরিহার্য আর প্রয়োজনীয় করে তুলতে চাও? তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী? এখন পর্যন্ত তুমি সুস্থ আছ, বেঁচে আছ, এর মানে হলো তুমি ওপরের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য সক্ষম আছ। এই সক্ষমতাকে কীভাবে তুমি নিজের, সমাজের আর বিশ্বের কাজে লাগাবে? কীভাবে তুমি হয়ে উঠবে অপরিহার্য? নিজেকে প্রশ্ন করো, স্থির মনে গভীরভাবে ভেবে দেখো। 

আমার জন্য জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল গল্পবলা। আর তোমার জন্য? তোমাকে নিজের থেকে করতে হবে এই অন্বেষণ।

আমি আশা করব, এত দিনে অর্জন করা তোমার সব শিক্ষা, মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা, সাহসকে সঙ্গী করে তুমি একটা সাম্যে, সৌহার্দ্যে, ন্যায়ে আর আনন্দে পরিপূর্ণ বিশ্ব গড়ার কাজে নেমে পড়বে। তোমরা আজ থেকে এক নতুন পথে চলা শুরু করবে, আমাদের পথ দেখাবে।


ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান