জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে নারীরা

ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত সব শ্রেণি–পেশার নারীরা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছাড়ছেন। দিন দিন এ ঝুঁকি বাড়ছে।  ফাইল ছবি
ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত সব শ্রেণি–পেশার নারীরা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছাড়ছেন। দিন দিন এ ঝুঁকি বাড়ছে। ফাইল ছবি

খেটে খাওয়া মানুষটির আট সন্তানের মধ্যে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের মেধাতালিকায় নাম উঠেছিল সুমাইয়ার। কয়েক বছর বাদে সেই সুমাইয়ার নাম ওঠে পুলিশের খাতায়। জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে আড়াই বছরের সন্তানসহ এখন কুষ্টিয়া কারাগারে আছেন। লোকে চেনে ‘জঙ্গি সুমাইয়া’ নামে।

গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) কমপক্ষে ৮৫ নারী জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে। জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে নিহত হন ১১ জন। এক নারী সন্তানকে সামনে ঠেলে দিয়ে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন।

বাংলাদেশের নারীদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পেছনে সিটিটিসি কোনো একক কারণ খুঁজে পায়নি। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ স্বামীরা স্ত্রীদের জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবও উদ্বুদ্ধ করেছেন কোথাও। কোথাও ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগের মাধ্যমে নারীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। কোথাও নারী নিজেই সঙ্গী বা স্বামীকে উদ্বুদ্ধ করেছেন জঙ্গিবাদে।

সুমাইয়ার ভাই হজরত আলী বলছিলেন, সুমাইয়া যে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন, সে সম্পর্কে তিনি বা তাঁর পরিবারের লোকজন জানতে পারেন ২০১৭ সালে, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেপ্তারের পর। সুমাইয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়তেন। ছুটিতে নাটোরের বাড়িতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার কথা বলে নিখোঁজ হলে পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পাঁচ মাস পর তিনি গ্রেপ্তার হন। তাঁরা জানতে পারেন, এক ফুপাতো ভাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এক জঙ্গির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কথিত হিজরতে পাঠিয়েছেন।

সুমাইয়া যে অভিযানে গ্রেপ্তার হন, ওই একই অভিযানে আইএসপন্থী জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির অন্যতম নেতা আইয়ূব বাচ্চু ওরফে সজীবের স্ত্রী আশরাদি জাহান তিথি ও আরমানের স্ত্রী টলি আরাও গ্রেপ্তার হন। ওই আস্তানা থেকে পুলিশ সুইসাইডাল ভেস্ট, বিস্ফোরক, গান পাউডার ও পিস্তলও উদ্ধার করে।

জঙ্গি আস্তানায় অভিযান পরিচালনাকারী এক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারের সময় সুমাইয়া কাঁদছিলেন। বলছিলেন, তিনি তাঁর নিজের স্বপ্নকে মাটিচাপা দিয়েছেন।

স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের কর্মকর্তা আবদুল মান্নান জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ৮৫ জন নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার নারীদের বড় অংশই উগ্রবাদে দীক্ষিত ছিলেন না। শতকরা ৫২ জন উদ্বুদ্ধ হওয়ার পেছনে একাধিক কারণের কথা বলেছেন। শতকরা ২১ ভাগ জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন স্বামীর কারণে। তা ছাড়া পরিবার উদ্বুদ্ধ করেছে ৭ শতাংশ নারীকে, বাবা, ভাই, ছেলে ও বন্ধু ১৪ শতাংশ, ধর্মীয় গুরু ৪ শতাংশকে ও ৩ শতাংশ অনলাইন ও ফেসবুকে উদ্বুদ্ধ হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আবেদাতুন ফাতেমা আশা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, স্বামী তানভীর কাদেরী তাঁকে ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। একা কীভাবে থাকবেন, সেই চিন্তা থেকে তিনি বাধ্য হয়ে সেভ দ্য চিল্ড্রেনের উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে তথাকথিত ‘হিজরত’ করেন।

আবেদাতুন ফাতেমা আশা এখন কারাগারে আছেন। ২০১৬ সালে আজিমপুরের আস্তানায় তিনি ও তাঁর আরও দুই সহযোগী পুলিশের ওপর মরিচের গুঁড়া ছিটিয়েছিলেন। আর স্বামী গ্রেপ্তার এড়াতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আত্মঘাতী হন। যমজ দুই সন্তানের একজন ২০১৬ সালে আশকোনার সূর্য ভিলায় অভিযানে নিহত হয়। অন্যজনও সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় জড়িয়েছে।

ভোলার চরফ্যাশনের মেয়ে শাকিরাকেও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাঁর স্বামী। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে শাকিরা প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর ঢাকায় চলে এসেছিলেন মেয়েকে নিয়ে। দ্বিতীয় দফায় যাঁকে বিয়ে করেছিলেন, তিনি জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ ছিলেন।

শাকিরার বাবা মো. শাহ আলম বলেন, আশকোনার সূর্য ভিলায় অভিযানের বেশ কিছুদিন আগে মেয়ে বাড়ি এসেছিলেন। আত্মীয়স্বজন প্রত্যেকের সঙ্গে দেখা করে উধাও হয়ে যান। একদিন গভীর রাতে অপরিচিত নম্বর থেকে মেয়ে ফোন করে জানায়, পুলিশ বাড়ি ঘিরে রেখেছে। আর দেখা হবে না।

পরে গোটা দেশের মানুষের মতো মো. শাহ আলমও জানতে পারেন, শাকিরা তাঁর ছোট্ট মেয়েটিকে পুলিশের হাতে ঠেলে দিয়ে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। মেয়েটির বয়স এখন আট। বিস্ফোরণের শারীরিক ক্ষত কাটিয়ে উঠেছে। মানসিক ক্ষত কতটা কাটিয়ে উঠেছে বুঝতে পারেন না বৃদ্ধ নানা। কখনো সে মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করে না।

পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্তর্জালে ফাঁদ

সিটিটিসি বলছে, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্টাডি গ্রুপ, মসজিদ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন নারীরা। কেউ কেউ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন হতাশা থেকে কিংবা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে।

অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে এক নাগরিককে ছুরিকাঘাত করে সে দেশের জেলে আছেন মোমেনা সোমা। মোমেনা সোমা নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল নজিবুল্লাহ আনসারী নামের এক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। নজিবুল্লাহর পরিবার বিয়েতে রাজি না হলে নজিবুল্লাহ আইএসে যোগ দিতে দেশ ছাড়েন, এখন নিখোঁজ। মোমেনা তুরস্ক যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

অনলাইনে উদ্বুদ্ধ হওয়া নারীদের সংখ্যা পুলিশের হিসাবে ২ শতাংশ এবং ফেসবুক থেকে ১ শতাংশ। ২০১৮ সালে নরসিংদীর পুলিশি অভিযানে নিহত আকলিমা আক্তার ওরফে মণি ও কারারুদ্ধ দুই বান্ধবী খাদিজা পারভীন ওরফে মেঘলা এবং ইশরাত জাহান উদ্বুদ্ধ হন অনলাইনে। মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের প্রাক্তন এই তিন ছাত্রী উদ্বুদ্ধ হওয়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় তালিমে অংশ নিতেন।

২০১৮ সালের এপ্রিলে মেয়ে জান্নাতুল নাইম মিতুর জঙ্গিবাদে যুক্ততার কথা বাবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানান। পরে জান্নাতুলের বাবা ও স্বামীর দেওয়া তথ্যে র‍্যাব গ্রেপ্তার করে তাঁকে।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের পুরোনো জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদ, বাংলাদেশ (হুজি, বি), জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (পুরোনো জেএমবি) বা আল-কায়েদা সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল ইসলামের আগে নারী শাখা ছিল না। তবে আইএসপন্থী নব্য জেএমবি নানা কারণে ব্যাপকভাবে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করছে। যত নারী জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন, তাঁদের ৬৩ শতাংশই নব্য জেএমবির, ২৩ শতাংশ পুরোনো অংশের।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কমপক্ষে ৫০ ভাগ জনগোষ্ঠী নারী হওয়ায় তাঁদের কাছে নারী জঙ্গিরা সহজে পৌঁছাতে পারেন এবং পুরো পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, নারী জঙ্গিরা সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়েন, তাঁদের সহজেই তথ্যদাতার কাজে লাগানো যায়। এ ছাড়া নারী হওয়ায় তাঁরা নিরাপত্তা বাহিনীর নজর সহজেই এড়াতে সক্ষম হন।

করণীয় কী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, মেয়েদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার একটি কারণ হলো বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহের পর কোনো পরিবারে জঙ্গিবাদের চর্চা হলে মেয়েটিও আর ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। এ ছাড়া শুধু স্কুল-কলেজের ফল বা চাকরিই যে ক্ষমতায়ন নয়, তা জঙ্গিবাদে যুক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার নারীদের বেলায় পরিষ্কার হয়েছে।

 ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণদের সম্পৃক্ততায় সবাই অবাক হয়েছিলেন। একইভাবে চমকে উঠেছেন সপরিবারে দেশ ছেড়ে ইসলামিক স্টেটে যোগ দিতে যাওয়া নারীদের দেখে, ঢাকায় আত্মঘাতী বোমা হামলার চেষ্টা দেখে, রাজশাহীতে ধারালো রামদা নিয়ে নারীকে পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়াতে, সন্তানসহ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ নিয়ে বসবাস করতেও।

সিটিটিসি বলছে, জঙ্গিবাদে নারীদের ঝুঁকি বাড়ছে। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধেও নারীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। পরিবারের কেউ বদলে গেলে তা সবার আগে পরিবারের নারীদের চোখে ধরা পড়ে।