করোনায় বিপদে হবু মায়েরা

'করোনার শুরুতে আমার এক সহকর্মী অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে চারটা হাসপাতালে ঘুরলেন। কোনো হাসপাতালই তাকে নিলো না। এভাবে বাচ্চাটাও মারা গেলো। এরপর থেকে আতঙ্ক আমারও পিছু ছাড়ছে না।'

এভাবেই করোনায় নিজের অসহায়ত্বের কথা বললেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আয়শা রহমান। ৩০ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা আয়শা এখনও জানেন না তার শিশুর জন্ম কোন হাসপাতালে হবে, এমনকি নিয়মিত চিকিৎসা পেতেও বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। করোনার প্রাদুর্ভাবে এভাবেই অসহায় হয়ে পড়েছেন গর্ভবতীরা।

গত সপ্তাহে মাতৃত্ব ও শিশুযত্ন বিষয়ক একটি ফেসবুক গ্রুপে নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় সেখানে অন্তত ২০ অন্তঃসত্ত্বা নারী করোনার কারণে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কেউ কেউ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। অনেক চিকিৎসকের চেম্বার এবং ক্লিনিক বন্ধ ঘোষণা করা হলে বিপদে পড়েন এসব নারীরা। বার বার চিকিৎসক খোঁজায় বাড়ছে ভোগান্তি, আতঙ্ক এবং ঝুঁকিও। সঙ্গে বাড়ছে খরচও।

গত বুধবার ঢাকার একটি হাসপাতালে সন্তান জন্ম নেয় মোস্তাফিজুল আলম ও নাজমিন আক্তার দম্পতির। মোস্তাফিজুল আলম জানান, গর্ভাবস্থার মাঝামাঝিতে করোনা আসে। যে হাসপাতালে তাঁদের নিয়মিত যে চিকিৎসক দেখতেন সেই হাসপাতালটাই বন্ধ করে দেওয়া হয়, এরপর প্রায় দশ সপ্তাহ কোনো ডাক্তারের কাছে যেতে পারেননি তাঁরা। অবশেষে এক বন্ধুর অনুরোধে একজন চিকিৎসক তাঁদের গ্রহণ করলে তার অধীনেই বুধবার সন্তান জন্ম নেয় তাঁদের। মোস্তাফিজ বলেন, 'হয়তো আমার আর্থিক সংগতি ছিল বলে আমি এই সেবার ব্যবস্থা করতে পারলাম, অন্যথায় এসময় এই সেবা পাওয়া আমার জন্য কঠিন হয়ে যেত।'

করোনারকালে মাস্ক পরে অপরেশন থিয়েটার থেকে বের হওয়া নাজমিন আখতার, সঙ্গে নবজাতক ইরতিজা মায়ান। স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা, ১ জুলাই ছবি:  মাকসুদা আজীজ
করোনারকালে মাস্ক পরে অপরেশন থিয়েটার থেকে বের হওয়া নাজমিন আখতার, সঙ্গে নবজাতক ইরতিজা মায়ান। স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা, ১ জুলাই ছবি: মাকসুদা আজীজ

চিকিৎসক এবং চিকিৎসা সেবার অপ্রাপ্তিতে ঢাকার বাসিন্দা উদ্যোক্তা জিনিয়া মেনেই নিয়েছেন চিকিৎসা সেবা ছাড়াই সন্তান জন্ম দিতে হবে তাকে। তিনি মনে করছেন, হাসপাতালে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়িতে সন্তান জন্মের ঝুঁকির চেয়ে বেশি। যেহেতু তার কোনো সমস্যা নেই, এবং পরিবারে চিকিৎসক আছেন তাই তিনি বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।

চিকিৎসকের প্রাপ্তি থাকলেও ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে পারছেন না গর্ভবতীরা। সদ্য সন্তান প্রসব করা বেসরকারি কর্মকর্তা রুবিনা খান তার গর্ভাবস্থায় দুইবার হাসপাতাল বদলেছেন আর চিকিৎসক বদলেছেন পাঁচবার। তার দুইজন চিকিৎসক নিজেরাই করোনা পজেটিভ ছিল। ফলে ঝুঁকি ছিল রুবিনারও।

যখন গর্ভবতীদের চিকিৎসায়ই এতখানি অসুবিধা, সদ্য প্রসূতিরা গুরুত্ব পাচ্ছেন অনেক কম। ঢাকার বাসিন্দা রাবিতা রকিব জানান, গর্ভাবস্থায় তাও চিকিৎসা পাওয়া গেছে কিন্তু প্রসবের পর কোনোভাবেই চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না, এমনকি টেলিমেডিসিন সেবা নিতেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

করোনার কারণে গর্ভবতী ও প্রসূতিদের এইসব সমস্যার কথা স্বীকার করেন, অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট রওশন আরা বেগম। তিনি বলেন, আগে চিকিৎসা সেবা পাওয়া দুরূহ হলেও এখন অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে। তিনি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অন্তত চারবার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ এবং দুইবার আল্ট্রাসনোগ্রামের পরামর্শ দেন। ছাড়াও কোনো উপসর্গ না থাকলে প্রসবের আগে এবং প্রাথমিক গর্ভাবস্থায় করোনা সন্তানকরণের পরামর্শ দেন তিনি। করোনার মাহমারিতে সন্তান না গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেন তিনি।