বাঙালি ফুটবল রেফারি কন্যার জার্মান জয়

ফরিদা কাজল।  ছবি: সংগৃহীত
ফরিদা কাজল। ছবি: সংগৃহীত

মাঠে দুদলের ২২ জন পুরুষ ফুটবলার। দুজন সহকারী রেফারি পুরুষ। কিন্তু সারা মাঠে একজন মাত্র নারী, যাঁর হাতে রয়েছে প্রধান রেফারির বাঁশি। বাংলাদেশে এমন ঘটনা বিরল। অথচ ইউরোপের ফুটবলে দৃশ্যটা প্রায়ই দেখা যায়। আর যাঁর হাতে বাঁশি, তিনি বাংলাদেশেরই মেয়ে ফরিদা কাজল। জার্মান ফুটবল লিগের রেফারিদের কাছে পরিচিত মুখ ফরিদা।

ঢাকায় পাইওনিয়ার ফুটবল, বঙ্গমাতা ও বঙ্গবন্ধু স্কুল ফুটবল, ক্লাব কাপ, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে একসময় অনন্য দক্ষতায় খেলা পরিচালনা করেছেন ফরিদা। সেই অভিজ্ঞতা যে এভাবে কাজে লাগবে, তা কখনোই ভাবেননি শরীয়তপুরের এই মেয়ে। জার্মানির লাইপজিগে গিয়ে বদলে ফেলেছেন ভাগ্যের চাকা। লাইপজিগের স্থানীয় ফুটবল লিগের বিভিন্ন ম্যাচ পরিচালনার পাশাপাশি বার্লিনেও অনেক টুর্নামেন্টে বাঁশি বাজাচ্ছেন ফরিদা।

২০০৭ সালে ফরিদা ঢাকায় ক্রিকেট খেলতেন। তিন বছর খেলেছেন আবাহনীর হয়ে। মেয়েদের জাতীয় দলের বাছাইয়ে টিকলেও চূড়ান্ত দলে জায়গা পাননি। হতাশ ফরিদা ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি তাইতো ফুটবলের রেফারি ট্রেনিং শুরু করেন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) রেফারি কমিটির যোগ্যতার পরীক্ষায় পাস করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিয়মিত রেফারিং করেছেন দেশে। একসময় ভলিবল রেফারিং কোর্সও করেন। রেফারিংয়ের পাশাপাশি সমাজকর্মের ওপর স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেন ফরিদা। একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি ২০১১ সালে শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে বিপিএড পাস করেন ফরিদা। রেফারিংয়ের আয়ে নিজের খরচ চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ছিল। তাই ঢাকার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে কয়েক বছর ক্রীড়া শিক্ষকের চাকরি করেছেন।

২০১৪ সালে সুযোগ পান জার্মানির লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রীড়াশিক্ষার ওপর পড়াশোনা করার। জার্মান সরকারের দেওয়া বৃত্তি নিয়ে ২০১৫ সালে ভর্তি হন লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি তত দিনে জার্মান ভাষাটাও শিখতে শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করলেও ফরিদার মন পড়ে থাকত ফুটবল মাঠে। রেফারিংয়ের জন্য সুযোগ খুঁজতে শুরু করেন। জার্মানির পঞ্চম স্তরের ক্লাব এফসি গ্রিমায় নিজের আগ্রহের কথা জানিয়ে একটা আবেদন করেন। ফরিদার সব কাগজপত্র দেখে ক্লাবটি সন্তুষ্ট হয়। এরপর এফসি গ্রিমা ক্লাবের সহায়তায় স্থানীয় লিগে রেফারিংয়ের সুযোগ দেওয়া হয় তাঁকে।

লাইপজিগে মেয়েদের ফুটবল ম্যাচে প্রধান রেফারি বাংলাদেশের ফরিদা কাজল (বল হাতে মাঝখানে)। জার্মানিতে ছেলেদের ফুটবল ম্যাচও পরিচালনা করেন ফরিদা।  ছবি: সংগৃহীত
লাইপজিগে মেয়েদের ফুটবল ম্যাচে প্রধান রেফারি বাংলাদেশের ফরিদা কাজল (বল হাতে মাঝখানে)। জার্মানিতে ছেলেদের ফুটবল ম্যাচও পরিচালনা করেন ফরিদা। ছবি: সংগৃহীত

জার্মানিতে প্রথম দিনে খেলা চালানোর অভিজ্ঞতাটা চমৎকার ছিল উল্লেখ করে ফরিদা বলেন, ‘২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ছিল আমার প্রথম ম্যাচ। প্রথম দিনেই ছেলেদের খেলা। একটু ভয় করছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। সবাই প্রশংসা করেছিল।’

মেয়ে বলে কখনো কেউ উপেক্ষা করেনি ফরিদাকে। বললেন, ‘আমার গায়ের রং কালো বলে শুরুতে ভয় পেতাম। ভাবতাম, ওরা আমাকে সম্মান করবে না। মাঠে ভয় পাবে না। কিন্তু প্রতিটি ম্যাচেই ওরা ভালোভাবে সহযোগিতা করেছে। মেয়ে বলে কখনো অবহেলা করেনি।’

 স্থানীয় লিগে ভালো পারফরম্যান্সের জন্য এরই মধ্যে পদক পেয়েছেন ফরিদা। খেলা চালাতে গিয়ে মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে ফরিদার, ‘ছেলেদের ম্যাচে একবার এক গোলকিপারকে লাল কার্ড দিই। ছেলেটা ডি-বক্সের বাইরে এসে বল ধরেছিল। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে মাফ চেয়েছিল আমার কাছে।’

সুযোগ পেলেই স্টেডিয়ামে বসে বুন্দেসলিগার ম্যাচ দেখেন ফরিদা। স্থানীয় আরবি লাইপজিগের সঙ্গে বায়ার্ন মিউনিখ, এফসি শালকের অনেক ম্যাচ লাইপজিগ স্টেডিয়ামে বসে উপভোগ করেছেন। করোনাভাইরাসের কারণে আপাতত লাইপজিগে সব রকমের ফুটবল বন্ধ। দুঃসময় শেষে আবারও মাঠে ফিরতে যেন তর সইছে না ফরিদার।