দুর্যোগে সহায় এই নারীরা

কক্সবাজারে সিপিপি স্বেচ্ছাসেবকদের মহড়া চলছে।  ছবি সংগৃহীত
কক্সবাজারে সিপিপি স্বেচ্ছাসেবকদের মহড়া চলছে। ছবি সংগৃহীত

আকাশে কালো মেঘ, সমুদ্র উত্তাল। আবহাওয়ার বার্তা বলছে, ধেয়ে আসছে প্রবল ঘূর্ণিঝড়। নিরাপদ আশ্রয়ে না থেকে এ সময়ে মানুষকে ঝড়ের আগাম বার্তা দিতে মাইক হাতে নেমে পড়েন হাসিনা আকতার। তাঁর দলের অন্যরাও এ সময় ঘরের বাইরে। মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে ব্যস্ত তাঁরা। প্রয়োজনে ত্রাণও বিতরণ করেন। হাসিনা আকতার সরকারের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) একজন স্বেচ্ছাসেবী।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরহাজারী গ্রামের হাসিনা আকতার ২৭ বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। পেশায় তিনি একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মাঠপর্যায়ে কাজ করেন সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকেরা। দেশের ৪১টি উপকূলীয় উপজেলায় ৩ হাজার ৭০১টি ইউনিট আছে। একটি ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেন ১০ জন পুরুষ এবং ৫ জন নারী। বর্তমানে মোট স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা ৫৫ হাজার ৫১০, যার অর্ধেকই নারী। তাঁদেরই একজন এই হাসিনা গত বছর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কারও পেয়েছেন।

সিপিপি যাত্রা শুরু করে ১৯৭৩ সালে। তখন শুধু পুরুষ স্বেচ্ছাসেবী ছিল। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান ১ লাখ ৩৯ হাজার মানুষ। ওই ঝড়ে শুধু পটিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর উপকূলে ৪২ হাজার মানুষের লাশ পাওয়া যায়।

সিপিপির আদ্যোপান্ত জানা চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক মো. রুহুল আমিন বলেন, ২৯ এপ্রিলের ঝড়ে নিহত লোকজনের একটা বড় অংশ ছিল নারী ও শিশু। ওই ঝড়ের পরে ১৯৯৩ সাল থেকে সিপিপিতে নারী স্বেচ্ছাসেবক অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্বরান্বিত হয়েছে যথেষ্ট।

প্রথম বছরেই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন হাসিনা। ২৯ এপ্রিল রাতের ভয়াবহ স্মৃতি তাঁকে তাড়া করে ফিরছিল। ঝড়ের পর একটি বেসরকারি সংগঠনের হয়ে ত্রাণের কাজের অভিজ্ঞতা সিপিপির স্বেচ্ছাসেবী হতে সহযোগিতা করে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারীদের অবদান বিবেচনা করে সরকার সিপিপিতে এখন পুরুষের সমপরিমাণ অর্থাৎ ১০ জন নারী স্বেচ্ছাসেবক রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানালেন সিপিপির প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক (প্রশাসন) আহমাদুল হক। বললেন, শুধু সংখ্যাগত বৃদ্ধি না, নারী স্বেচ্ছাসেবকদের গুণগত মান বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া নারীরা যেন নেতৃত্বে আসতে পারেন, সেই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

তবে শুরুর দিকে নারীদের জন্য কাজ করা কঠিন ছিল। দুই সন্তানের মা হাসিনা বললেন, ‘ছেলেদের সঙ্গে থেকে দুর্যোগের সময় উদ্ধারকাজ করব, এসব নিয়ে নানা কথা হতো। গঞ্জনা সহ্য করেছি। এখন আর সেই দিন নেই।’

পাহাড়ধস, বন্যা বা অন্য যেকোনো মানবসৃষ্ট দুর্যোগে সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকেরা সতর্ক বার্তা জানানো, আশ্রয় নিতে সহযোগিতা, উদ্ধার, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং ত্রাণ সহায়তা দেন।

গেল বছর সেপ্টেম্বরে টেকনাফ পৌরসভার পুরোনো কল্যাণপুর এলাকার বাসিন্দা কুলসুমা বেগম ভোররাতে পাহাড়ধসের প্রচণ্ড শব্দ শুনে বাড়ি থেকে বের হন। দেখেন কাছের ফকিরামুড়া এলাকায় ধসে পড়া পাহাড়ে চাপা পড়েছে বাড়ি। মুহূর্তের মধ্যে মুঠোফোনে ডেকে আনেন দলের অন্য সদস্যদের। খবর দেন ফায়ার সার্ভিসে। দ্রুতগতিতে উদ্ধার হয় তিন নারী ও এক শিশু। দুজনের মৃত্যুও হয়। ধসের ঘটনার পরে কুলসুমা প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন আহত লোকজনকে। এখন কোভিড-১৯-এর এ সময়ে ঘরে বসে নেই। চালাচ্ছেন সচেতনতামূলক প্রচার।

একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার টেকনাফের কর্মী কুলসুমা বললেন, ‘যখন স্বেচ্ছাসেবী হতে চাইলাম, পরিবার থেকেই বাধা এল। বলা হলো, এসব ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী? আমি বললাম, সবাইকে নিয়ে তো ভালো থাকতে হবে। আমার প্রতিবেশী যদি খারাপ থাকে, আমি কি ভালো থাকতে পারব?’

 বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার মিঠাখালীর সুস্মিতা মণ্ডল। সদ্য স্নাতক সুস্মিতা সিপিপির কনিষ্ঠতম সদস্য। মোংলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরের গ্রাম দত্তেরমেটের এই বাসিন্দা বললেন, ‘রাত নেই, দিন নেই আমাদের কাজ করতে হয়। নিন্দুকেরা নানা কথা বলে। আমি অবশ্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। কারণ এসব নিন্দুকই আমার কাজের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে।’

গেল বছর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর সহকর্মীদের নিয়ে ভোর থেকে ১৪ কিলোমিটার রাস্তার ডাল কেটে রাস্তা পরিষ্কার করে ফেলেন সুস্মিতা। নিরাপদে মানুষকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, ত্রাণ তৎপরতা সবকিছুর সঙ্গেই ছিলেন মা-বাবার এই একমাত্র সন্তান। মে মাসে হয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় প্রচার থেকে শুরু করে উদ্ধারকাজেও অংশ নেন। এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে নিয়েছেন পুরস্কার।

দুর্যোগবিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলছিলেন, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছাসেবী নারীদের অবদান অসামান্য। যেকোনো দুর্যোগের বড় শিকার হন নারী ও শিশুরা। অন্যদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণ ঝুঁকি কমিয়েছে।’

বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান মনে করেন এর সিংহভাগ কৃতিত্বের দাবিদার সিপিপির স্বেচ্ছাসেবীরা। আর এর মধ্যে নারীদের ভূমিকাই অগ্রগণ্য। এনামুর রহমান বলেন, ‘নারী স্বেচ্ছাসেবীদের কাজের গতি অনন্য। তাঁদের নিষ্ঠা সর্বত্র প্রশংসিত।’