গাছেরও তো প্রাণ আছে...

মানসী বনিক
মানসী বনিক

সাভারের ধামরাইতে অবস্থিত বাড়িটি প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো। চারপাশে নানান গাছপালা। বাড়ির ভেতরে একটি ওয়াশ রুমের বাইরের দিকের দেয়ালটিকেই ক্যানভাস বানিয়েছেন মানসী বনিক। এর আগে এ দেয়ালের সঙ্গে লাগানো দেড় বছর ধরে একটা বাগানবিলাস গাছকে বড় করেছেন। গাছটি কেটে নারীর চুলের আকৃতি দিতে সহায়তা করেছেন স্বামী সুকান্ত বনিক। তারপর রংতুলি দিয়ে ঝাঁকড়া চুলের নিচে এক নারীর মুখ এঁকেছেন মানসী। সম্প্রতি কাজটি শেষ করেছেন তিনি।

বিদেশে এ ধরনের কাজ করেন শিল্পীরা। মানসী বনিক অবশ্য কাজটি করেছেন অন্য চিন্তা থেকে। বললেন, গত কয়েক বছরে সড়ক উন্নয়নসহ নানা কাজের জন্য বিভিন্ন সড়কের পাশের বড় গাছগুলো দ্রুত কেটে ফেলা হচ্ছে। বিষয়টি তাঁকে কষ্ট দেয়। আক্ষেপ করে বললেন, মানুষ কেন বুঝতে পারে না যে গাছেরও তো প্রাণ আছে।

মানসী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেইন্টিংসে এমএ করেছেন। ফটোগ্রাফি শেখার জন্য পাঠশালা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আছে নিজস্ব স্টুডিও। ছবি আঁকা ও তোলার পাশাপাশি শ্বশুরবাড়ির পঞ্চম পুরুষ ধরে পারিবারিক ব্যবসা, বর্তমানে ধামরাই মেটাল ক্র্যাফট নামের কাঁসা-পিতলের কারখানাটি পরিচালনা করছেন স্বামী সুকান্ত বনিক ও মানসী। এখানকার ডিজাইনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন মানসী।

সৌগত বনিক ও ঋষীকা বনিকের মা মানসী জানালেন, নিজের তোলা ছবি বিক্রির টাকা দিয়েছেন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে দুর্গত মানুষের সহায়তায়। পারিবারিকভাবেও কারিগর পরিবার এবং নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন মানসী ও তাঁর স্বামী।

মানসীর মা–বাবার বাড়ি ময়মনসিংহে। মানসী বড় হয়েছেন রাজধানী ঢাকায়। ২০০৬ সালে বিয়ের পর থেকে থাকছেন ধামরাইতে।

গাছ ও রংতুলির মিশেলে মানসী বনিকের আঁকা ছবি।  ছবি সংগৃহীত
গাছ ও রংতুলির মিশেলে মানসী বনিকের আঁকা ছবি। ছবি সংগৃহীত

মানসী তাঁর আঁকা ছবি এবং ফটোগ্রাফিতে নারীর জীবনের কঠিন বাস্তবতা, হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যসহ বিভিন্ন বিষয়কে ফুটিয়ে তোলেন। জানালেন, অনার্স পড়ার সময় বিয়ে হয়। দ্বিতীয় সন্তান পেটে নিয়ে মাস্টার্স পরীক্ষা দেন। নিজের জন্মদিনেই দ্বিতীয় ছেলের জন্ম হয়। দিল্লিতে ছেলের হার্টের ছিদ্রের ভুল চিকিৎসায় ১ বছর ১২ দিনের মাথায় ২০১৭ সালে এ ছেলে মারা যায়। সেই কষ্ট ভুলতে কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন।

মানসী স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মানসী জানালেন, দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন তিনি। রক্ষণশীল বাবার ছিল কড়া শাসন। অন্যদিকে মায়ের শখ ছিল মেয়ে নাচবে, গাইবে, ঘুরে বেড়াবে। তাই মা ও মেয়ে যা কিছু করার, তা লুকিয়ে করতেন।

মানসী হেসে বললেন, ‘ এখন স্বামীর ইচ্ছেয় একটা করে কাজ করার পর মনে হয়, মায়ের একটা ইচ্ছাও পূরণ করলাম।’

বাড়িটিতে ২১ জন কারিগরের কাজের তদারকির পাশাপাশি রুপার গয়না নিয়েও কাজ করেন মানসী।

বিদেশিরা বাংলাদেশে কোথায় কোথায় বেড়াতে যেতে পারেন, সে তালিকায় মানসীদের বাড়ির ঠিকানা দেওয়া আছে। রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে বিদেশি অতিথিরা আসেন এ বাড়িতে। কোনো কোনো সময় ৩০ থেকে ৪০ জন অতিথিও হুট করে ঘুরতে চলে আসেন। আর অতিথি আপ্যায়নের জন্য নিজের হাতেই রান্না করেন মানসী।