শখ যা ছিল আড়ালে

>

মনে হতে পারে বুঝি ‘বহুকাল আগের কথা’। ক্লাস ছিল, আড্ডা ছিল, চায়ে চুমুকের সঙ্গে তুমুল তর্ক ছিল, বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল, ছিল না শুধু সময়। করোনাকালীন এই দীর্ঘ বন্ধের দিনে অনেক নেইয়ের মধ্যে ওই সময়টুকুই প্রাপ্তি। ঘরে থাকার সময়টা কাজে লাগাতে শিক্ষার্থীদের অনেকেই সৃজনশীল নানা কাজে যুক্ত হয়েছেন। যে শখগুলো সময়ের অভাবে আগে পূরণ হয়নি, এই সময়ে অনেকে সেগুলো পূরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। বেশ কয়েকটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের এ সময়ের সৃজনশীল কাজগুলোর খোঁজখবর নিয়ে লিখেছেন জাওয়াদুল আলম

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রিকেটবিষয়ক ভিডিও তৈরি করেন আজমল ও মারুফ। ছবি: সংগৃহীত
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রিকেটবিষয়ক ভিডিও তৈরি করেন আজমল ও মারুফ। ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেটের প্রেমে
ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আজমল তানজীম বরাবরই ক্রিকেটপাগল। ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি একটি এফএম রেডিওতে ক্রিকেটের ধারাভাষ্যও দেয় সে। অনেক দিন ধরেই বন্ধু মারুফ হোসেনের সঙ্গে ক্রিকেট–বিষয়ক একটা ইউটিউব চ্যানেল শুরু করার কথা ভাবছিল। তবে ব্যাটে-বলে মিলছিল না। অবশেষে ১৩ মার্চ আল্ট্রা এজ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ খোলে দুই বন্ধু। ক্রিকেট ম্যাচ বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার, টক শোসহ মূলত ক্রিকেটকে ঘিরেই বিভিন্ন বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) বানাবেন—এখন পর্যন্ত এই হলো পরিকল্পনা।

ভিডিও সম্পাদনায় সাহায্য করত তাদের আরেক বন্ধু শিহাবুর রহমান। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাকে নিয়ে প্রথম ভিডিওটি বানিয়েছে তারা। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে ভিডিও নির্মাণ চলছে। তাদের আয়োজিত টক শোতে অতিথি হয়ে এসেছেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের ক্রিকেটার রাকিবুল হাসান ও পারভেজ ইমন। এখন পর্যন্ত মোট ছয়টি ভিডিও বানানো হয়েছে।

আজমল বলে, ‘আমরা শুরু থেকেই ভিডিওর সংখ্যার চেয়ে মানের ওপর বেশি নজর দিচ্ছি। তাই সময় নিয়ে প্রতিটি ভিডিও বানানোর চেষ্টা করছি।’ ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতে হচ্ছে। জ্ঞানের পরিধি তো বাড়ছেই, পাশাপাশি ইউটিউবের জন্য ভিডিও তৈরি, ডিজিটাল বিপণন, ভিডিও সম্পাদনার মতো বিষয়গুলোতেও দক্ষতা তৈরি হয়েছে বলে জানায় আজমল। তিন বন্ধু একসঙ্গে মাঠে-ময়দানে ঘুরে ঘুরে ভিডিওগুলো বানালে হয়তো মান আরও ভালো হতো। করোনাভাইরাসের কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না, এটা যেমন একটা আফসোস, অন্যদিকে ভালো দিক হলো, এই সময়ে খেলোয়াড় কিংবা ক্রীড়াজগতের মানুষেরা সময় দিতে পারছেন, কলেজপড়ুয়া এই তরুণদের আমন্ত্রণে অনেকেই তাঁদের অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। আজমলদের কাছে এটাই বড় প্রাপ্তি।

কোডিংয়ে সময় কাটছে সৈকতের
কোডিংয়ে সময় কাটছে সৈকতের

প্রোগ্রামিংয়ের আনন্দ
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ছাত্র সৈকত হোসেন। পড়ালেখার পাশাপাশি কোড স্টুডিও নামে নিজের একটি সফটওয়্যার তৈরির প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে চেষ্টা করছিলেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্টার্টআপ বা ছোটখাটো উদ্যোগের জন্য ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ বানিয়ে দিতেন তিনি। মার্চের শেষে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় নতুন কাজ আসা বন্ধ হয়ে গেল, বন্ধ হয়ে যায় সৈকতের টিউশনির সুযোগও। বলে রাখা ভালো, প্রথম বর্ষ থেকেই সৈকত নিজের খরচ নিজেই চালাতেন। কিন্তু আয়ের সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন তিনি।

কিছুদিন এভাবে বসে থাকার পর অনলাইন শিক্ষণমাধ্যম ইউডেমিতে মোবাইল ও ওয়েব অ্যাপ তৈরির কিছু ভিডিও কোর্স বানিয়ে ফেললেন। পাশাপাশি ভিডিওগুলো নিজের ইউটিউব চ্যানেলেও রাখলেন সৈকত। সবার ইতিবাচক সাড়া আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিল তাঁর। এদিকে জুনের শুরু থেকে আবার কোড স্টুডিওতে কাজ আসতে শুরু করে। সৈকত বলেন, ‘কোডিংয়ের আনন্দটা উপভোগ করছি বলেই ক্যাম্পাস বন্ধ থাকার পরও আমি বাড়ি যাইনি। মাঝেমধ্যে পদ্মা পাড়ে বসি। নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি।’ এরই মধ্যে রুয়েটের আরও ২০ শিক্ষার্থী সৈকতের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেছেন।

ইউটিউবে নিজের চ্যানেলের জন্য ভিডিও ধারণ, সম্পাদনা, সব একাই করেন টুইংক
ইউটিউবে নিজের চ্যানেলের জন্য ভিডিও ধারণ, সম্পাদনা, সব একাই করেন টুইংক

নাচে-সাজে-রান্নায়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী টুইংক কেরল বন্ধের সময়ে সৃজনশীল কাজের যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটিকে তাঁর পড়ালেখার অংশও বলা যায়। নৃত্যকলা বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। গত মে মাসে নিজের ইউটিউব চ্যানেল খুলেছেন তিনি। সেখানে নিয়মিত নিজের নাচ, রান্না, সাজসজ্জার টিউটোরিয়াল ভিডিও আপলোড রেখেছেন তিনি। টুইংকের ১৫টি ভিডিও এখন পর্যন্ত প্রায় ৭১ হাজার মানুষ দেখেছে।

ছোটবেলা থেকেই নাচ শিখতেন টুইংক। মায়ের চাকরির সুবাদে স্কুলজীবন কেটেছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। ফলে নাচের প্রশিক্ষণও নিয়েছেন অনেক জায়গায়। এখন নাচের ওপরেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন তিনি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাচের ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় নতুন করে শিখেছেন বলে জানালেন।

টুইংক বলেন, ‘আগে যখন নাচতাম, তখন অল্প কিছু মানুষ দেখত। কিন্তু এখন আমার নাচ ইউটিউবে হাজার হাজার মানুষ দেখছেন। এখানে দর্শকদের সরাসরি মন্তব্য করারও সুযোগও রয়েছে। তাই অনেক কিছু মাথায় রেখে জেনে-বুঝে প্রতিটি ভিডিও বানানোর চেষ্টা করি।’ নাচসহ অন্যান্য ভিডিও ধারণ, সম্পাদনা, সবকিছুর কাজ টুইংক একাই করেন।

ভাইকে নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি তৈরি করেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী রাদিয়া
ভাইকে নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি তৈরি করেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী রাদিয়া

ঘরবন্দী পরিচালকের ছবি
এই সময়ে ঘরে বসে সিনেমাও বানিয়ে ফেলেছেন অনেকে। কেউ কেউ জিতেছেন পুরস্কারও। প্রথম আলো ডটকম ও চা–শিঙারা আয়োজিত ‘কোয়ারেন্টিন শর্টফিল্ম ফেস্ট ২০২০’ প্রতিযোগিতায় সিনেমা বানিয়ে পুরস্কার জিতেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী আফ্রিদা মেহজাবিন ও রাদিয়া রুহুল।

আফ্রিদা সদ্য এসএসসি পাশ করেছে। পরীক্ষা শেষে ঘরে বসে অলস সময় কাটছিল। এই প্রতিযোগিতার খবর পেয়ে সে বানিয়ে ফেলেছে ফিশবোল নামে একটি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র। ছবির গল্প লেখা ও পরিচালনার কাজটি করেছে আফ্রিদা। আর অ্যানিমেশন তৈরিতে সাহায্য করেছেন বড় বোন ফারিয়া বেগম। টানা এক মাস ধরে দিন-রাত কাজ করেছে দুই বোন।

আফ্রিদা বলছিল, ‘আমি ছবি আঁকতে পারি। আর আমার বোন কারিগরি দিকটা ভালো বোঝে। আমরা চেষ্টা করেছি, দুজনের দক্ষতা একসঙ্গে কাজে লাগাতে। এর আগেও আমরা একটি অ্যানিমেশন ছবি বানিয়েছিলাম। সেটা আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পেয়েছিল।’

আফ্রিদা ও ফারিয়া—দুই বোন মিলে তৈরি করেছেন অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র
আফ্রিদা ও ফারিয়া—দুই বোন মিলে তৈরি করেছেন অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র

পুরস্কারপ্রাপ্ত আরেক খুদে নির্মাতা রাদিয়া একাই এক শ। চিত্রনাট্য, ভিডিও ধারণ, সম্পাদনা—সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েই সে নির্মাণ করেছে হয়তো একদিন। একাদশ শ্রেণিতে পড়ে সে। রাদিয়ার ভাই একজন বিশেষ শিশু। ভাইয়ের দৈনন্দিন সময় কীভাবে কাটছে, সেটাই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছে সে। রাদিয়া বলছিল, ‘আমার ভাইয়ের মতো যাঁরা শারীরিক কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধকতাকে আঁকড়ে বেঁচে আছেন, তাঁদের প্রতিটি দিনই কোয়ারেন্টিনের মতো। তাঁদের কোনো বন্ধু থাকে না, বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। নিজেকে নিয়েই ঘরবন্দী অবস্থাতে জীবন কেটে যায়।’

গোছানো কথা শুনলেই বোঝা যায়, কীভাবে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিটির সব কাজ গুছিয়ে নিয়েছে সে। তাই তো সেরা পাঁচ ছবির একটা হিসেবে জায়গা পেয়েছে হয়তো একদিন। হয়তো একদিন রাদিয়াকে আমরা একজন বড় পরিচালক হিসেবে আবিষ্কার করব।