আমার স্বপ্ন ছিল অনেক বড় : প্রিয়াঙ্কা চোপড়া

>অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া এখন বিশ্বের প্রভাবশালী নারীদের একজন। গত ১৪ জুলাই তিনি বক্তৃতা দেন গার্ল আপ লিডারশিপ সামিট ২০২০ আয়োজনে। ভার্চ্যুয়াল এই সম্মেলনে আরও যোগ দেন হিলারি ক্লিনটন, মিশেল ওবামা, মেগান মার্কেলের মতো বিশ্বের প্রভাবশালী নারীরা। প্রিয়াঙ্কার বক্তৃতার নির্বাচিত অংশ থাকল আজ।
প্রিয়াঙ্কা চোপড়া
প্রিয়াঙ্কা চোপড়া

আজ কথা বলতে চাই সহনশীলতা ও নেতৃত্ব নিয়ে, যেন বর্তমানের কোনো প্রতিকূলতাই আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নকে বাধাগ্রস্ত না করতে পারে। তাই এ প্রসঙ্গ ধরে আমি বলতে চাই একজন তরুণীর কথা। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ভারতে ২০১৪ সালে, গ্রীষ্মের কোনো এক দিনে। তাঁর জীবনের গল্প আমাকে প্রতিদিন অনুপ্রাণিত করে। তাঁর নাম সাধনা। দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম। সাধনার বয়স যখন ১৪ বছর, তখন তাঁর বাবার শারীরিক অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন, অবশ হয়ে যায় শরীরের একাংশ। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মানুষ আর কাজ করতে পারছিলেন না। ফলে থেমে যায় মেয়েটির পড়াশোনা। চোখের পলকে বদলে যায় সাধনার পরিবারের সবার জীবন।

এই পরিস্থিতিতে সাধনা চাইলেই হার মেনে কঠিন জীবনের সঙ্গে আপস করে নিতে পারতেন। কিন্তু সাধনা চুপ করে বসে থাকতে নারাজ। তিনি তাঁর মা–বাবার কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদের জন্য কাজ করব।’ এই ছোট্ট বাক্যই বদলে দেয় সাধনার জীবনের বাঁক। জীবিকার জন্য সাধনা তাঁর মায়ের সঙ্গে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। স্বল্প পরিসরে মানুষের ছেঁড়া কাপড় ঠিক করে দিতেন, জামার ছেঁড়া বোতাম লাগিয়ে দিতেন—এভাবে একটু একটু কাজ করতে থাকেন তিনি।

কাজ করতে করতে এক সময় একটা সেলাই মেশিন কেনেন সাধনা। এর কয়েক বছর পর সাধনা আরও কয়েকটি সেলাই মেশিন কিনে ফেলেন। নিজের আয় দিয়ে সাধনা সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন, বাবার চিকিৎসা করান। এর মধ্যেই সাধনা তাঁর ছোট বোন ও গ্রামের অন্য মেয়েদেরও সেলাইয়ের কাজ শেখাতে শুরু করেন, যেন দুঃসময়েও তাঁরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী থাকতে পারেন। কয়েক বছরের মধ্যেই সাধনার সেলাইয়ের কাজ থেকে এতটাই আয় হতে থাকে যে সে আর তাঁর ছোট বোন—দুজনই আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করে। এই পর্যায়ে মনে হতে পারে এটাই বুঝি সাধনার গল্পের মধুর সমাপ্তি, কিন্তু না।

সাধনা সেখানেই থেমে যাননি। সাধনা তাঁর এলাকার মেয়েদের এক করে নতুন উদ্যোগ নিলেন। এলাকায় যারই ছোট ছোট ব্যবসা ছিল—যেমন হাতে বানানো খাবার, পিঠা, হস্তশিল্পের কাজ করে আয় করে, এমন সবাইকে নিয়ে সাধনা মেয়েদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করে বিক্রি শুরু করলেন। ফলে গ্রামের প্রত্যেক মেয়েরই নিজের ব্যবসার বাইরেও আরেকটা সহায়ক আয়ের উৎস তৈরি হলো।

আমি সাধনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তুমি কীভাবে এ কাজে অনুপ্রাণিত হলে?’ আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে ওর জবাবটা। সে আমাকে খুবই ধীরস্থিরে বলল, ‘যে পরিস্থিতিতে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, আমি সেই পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করতে চাইনি। আমি দারিদ্র্য মেনে নিতে চাইনি। আমি সব সময় আমার চারপাশে দেখেছি অনেকেই মুখ বুজে জীবনের বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু আমি চুপ থাকতে চাইনি।’ এটাই হলো নেতৃত্ব। এটাই হলো আত্মোন্নয়নে বিনিয়োগ করা।

আমার বাবা আমাকে বলতেন, ‘প্রতিটি প্রতিকূলতার আড়ালে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের সুযোগ জড়িয়ে আছে।’ আর এটাই করেছিল সাধনা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ও স্বাধীন হওয়ার নজির স্থাপন করেছিল সে। স্বাবলম্বী ও স্বাধীন হওয়ার এই শিক্ষা আমি পেয়েছিলাম আমার মায়ের কাছ থেকে। সাধনার এই গল্প থেকে আমি এই শিক্ষাই পাই, নিজের মেধা ও শিক্ষার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে শুধু নিজের জীবনকেই বদলাতে পারব না, আমরা বদলে দিতে পারি আরও অনেকের ভাগ্য। শুরুটা শুধু করতে হবে, নিজেকে দিয়ে, নিজের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে।

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ভারতের একটি ছোট শহরে। কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। অনেকেই বলত, এসব স্বপ্ন কোনো দিন নাকি পূরণ হয় না; মেয়েদের বেলায় তো নয়ই। আমি সৌভাগ্যবান, কারণ আমার পরিবার সব সময় আমাকে উৎসাহ দিয়েছে আকাশ ছোঁয়ার জন্য। আর এ কারণেই আমার ভেতর সব সময় নৈতিকভাবে ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার স্পৃহা অটুট থাকে। তাঁদের অগাধ আস্থার কারণে আমার ভেতর আত্মবিশ্বাস জন্মেছে যে আমি চাইলেই লিঙ্গ ও বর্ণনির্বিশেষে যেকোনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। আমার পরিবার আমাকে বুঝিয়েছে যে নিজের জীবন নিজের আয়ত্তে এলেই আমি আমার চারপাশের মানুষকেও প্রভাবিত করতে পারব। আমিই হতে পারব দিনবদলের কান্ডারি। কিন্তু সব সময় শুরুটা করতে হবে নিজের থেকে। সমাজে বদল আনার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাখ লাখ অনুসারীর দরকার নেই। আমাদের শুধু দরকার একটা সাহসে ভরা হৃদয়, বদলের তাগিদ আর প্রতিশ্রুতি।

কোনো কাজই ছোট নয়। কোনো বয়সই তাচ্ছিল্য করার মতো নয়। সবাই যখন একসঙ্গে জেগে উঠব, তখনই আসবে দারুণ সব পরিবর্তন। আমাদের ক্ষমতা অসীম। আমি জানি, আজকে অনেকেই হয়তো এই কথাগুলো শুনে রাতে ভাববে, ‘আমি কীভাবে সমাজে বদল আনতে পারি?’ আমিও এটা ভাবব। চলো, শুরু করি এভাবে; চলো, আমরা আওয়াজ তুলি। চলো, আমরা সমাজের বদলগুলোর জন্য সোচ্চার হই, যেগুলো আমার ও আমার আশপাশের মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে। চলো, আমরা আজ আওয়াজ তুলি, যেন আমাদের পরের প্রজন্মকে এই দাবিগুলো আর না তুলতে হয়।

চলো, আমরা স্বাধীন হই। যদি সামনে কোনো অনুপ্রেরণা খুঁজে না পাও, তাহলে আজকের সাধনার গল্পটাকে মনে করো। এমন অনেক গল্প পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। ভেবে দেখো, অনেকের জন্য তো সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাটাও একধরনের বিলাসিতা। যারা দরিদ্র, যারা উদ্বাস্তু, যারা একটা তাঁবুতে পুরো পরিবার নিয়ে থাকছে; ভাবতেও পারে না ৬ ফুট দূরত্ব মেনে চলার নিয়মের গুরুত্ব—একবার তাদের কথা ভাবো।

বিশুদ্ধ পানি পাওয়াটাও অনেকের কাছে সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ বিশ্বের প্রায় ৭৮ কোটি মানুষের বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন–সুবিধা পাওয়ার সুযোগ হয় না। এমনকি নিশ্বাস নেওয়াটাও এখন সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ শুধু গায়ের রং, লিঙ্গ কিংবা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বিশ্বের অনেক দেশে অনেকেই নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছে। তাই আমি আশা করব, তোমার আর কিছু যদি না–ও থাকে, অন্তত কণ্ঠটা তো আছে। সেটা দিয়েই আওয়াজ তোলো। সুযোগ কখনোই সুষমভাবে বণ্টন হয় না। কিন্তু সবাই মিলে আওয়াজ তুললে আমরা একটা পৃথিবী একদিন গড়তে পারব, যেখানো কোনো মেয়েকেই কখনো তাঁর গায়ের রং, ধর্ম বা মেয়ে বলে চুপ করিয়ে দেওয়া হবে না। চলো, বাধাগুলোকে পেরিয়ে যাই। চলো, সোচ্চার হই। চলো এখনই শুরু করি, নিজের থেকে শুরু করি।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান, সূত্র: গার্ল আপের ইউটিউব চ্যানেল