ঢাকায় পূর্বপুরুষের খোঁজে

‘দ্য সাউথ গেট অব দ্য লালবাগ’, জোহান জোফানি, ক্যানভাসে তেলরং, ১৭৮৭, সংগ্রহ: চার্লস গ্রেগ
‘দ্য সাউথ গেট অব দ্য লালবাগ’, জোহান জোফানি, ক্যানভাসে তেলরং, ১৭৮৭, সংগ্রহ: চার্লস গ্রেগ

আড়াই শ বছর আগে চার্লস গ্রেগের পূর্বপুরুষ ছিলেন ঢাকায়। তাঁদের সে ইতিহাস বড় জমজমাট। শিল্প বিশারদ চার্লস আবার খুঁজে বের করেছেন ঢাকায় আঁকা আদিতম ইউরোপীয় ছবির শিল্পীরও পরিচয়। ঢাকা ও নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক আশ্চর্য গল্প।

‘নাগাপন ঘাট’, জোহান জোফানি, ক্যানভাসে তেলরং, ১৭৮৭ সংগ্রহ: চার্লস গ্রেগ
‘নাগাপন ঘাট’, জোহান জোফানি, ক্যানভাসে তেলরং, ১৭৮৭ সংগ্রহ: চার্লস গ্রেগ

এক ই-মেইলের সূত্রে অক্টোবর ২০১১-তে চার্লস গ্রেগের সঙ্গে আমার পরিচয়। সেটি পাঠিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের নবাবী-লখনৌ বিশেষজ্ঞ, আমার বন্ধু, ড. রোজি লুএলেন-জোন্স্। প্রথম চিঠিটিতে চার্লস নিজের সামান্য পরিচয় দিয়ে জানতে চান, আমি তাঁকে ঢাকার একটি প্রাচীন অভিজাত খ্রিষ্টান সমাধিসৌধের খোঁজ দিতে পারি কিনা। সঙ্গে পাঠান অপূর্ব দুটো চিত্রকর্ম: ‘দ্য সাউথ গেট অব দ্য লালবাগ’ ও ‘নাগাপন ঘাট’। প্রথম চিত্রকর্মটি ইন্টারনেটে আগেই দেখেছিলাম। কিন্তু পরের চিত্রটি—যেখানে নারিন্দার কলম্বো সাহেবের সমাধি রয়েছে—দেখে বিস্মিত হই। ছবি দুটোর উৎস হিসেবে চার্লস পাঠান ১৮৮০ সালের দিকে তোলা ওই জায়গার দুটো দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্রও। উত্তরে জানাই, এটি ঢাকার নারিন্দার খ্রিষ্টান কবরস্থানের কোনো এক রহস্যময় কলম্বো সাহেবের সমাধিক্ষেত্র।
তখনো কি জানি, কী অমূল্য চিত্রকর্মের ইতিহাসের পথ আমার সামনে! চার্লস শিল্প-ইতিহাসবিদ। ছয় বছর ধরে নিবিড় গবেষণা চালাচ্ছেন আঠারো শতকের ইউরোপের প্রখ্যাত শিল্পী জোহান জোফানির শিল্পকর্ম নিয়ে। তিনি জানালেন, ‘দ্য সাউথ গেট অব দ্য লালবাগ’ আর ‘নাগাপন ঘাট’-এর কথা সবাই বহুদিন ভুলে ছিল। ভুল করে তা অন্য শিল্পীর বলেও ভাবা হচ্ছিল। আসলে ওগুলো ছিল জোফানির আঁকা। দুটো ছবিই তিনি এঁকেছিলেন ঢাকায় বসে, ১৭৮৭ সালে। এ পর্যন্ত জানা তথ্য অনুযায়ী ইউরোপীয় কোনো শিল্পীর আঁকা এটিই ঢাকার প্রাচীনতম ছবি। হঠাৎ এমন আশ্চর্য তথ্য পেয়ে আমি তো উদ্দীপিত। জোফানির মাপের কোনো শিল্পী ঢাকায় এসেছেন এবং এমন দুটো অপূর্ব চিত্রকর্মের নমুনা রেখে গেছেন জেনে আমি রীতিমতো রোমাঞ্চিত। ‘নাগাপন ঘাট’ ছবিতে কলম্বো সাহেবের সমাধিসৌধ সনাক্ত করতে পেরে তৃপ্তিও এল।

জানুয়ারি ২০১২-তে আমার আমন্ত্রণে চার্লস ঢাকায় এলেন। জোফানির আঁকা লালবাগ ফটক ও নারিন্দায় কলম্বো সাহেবের সমাধিসৌধ দেখতে তিনি অধীর। চার্লসের পারিবারিক ঐতিহ্যও ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসের মতো বর্ণাঢ্য। তাঁর মা কিংবদন্তিতুল্য জেনারেল উইলিয়াম পামারের সরাসরি উত্তরসূরি। জেনারেল পামারের বিশদ জীবনকাহিনি ধরা আছে উইলিয়াম ডালরিম্পলের নন্দিত উপন্যাস হোয়াইট মুঘল-এ। তিনি ছিলেন ভারতের বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের সামরিক সচিব ও বন্ধু। পামার সাহেব বিয়ে করেছিলেন দিল্লির মোগল-দুহিতা ফাইয়াজ বখশকে। তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান চার্লস পামার বিয়ে করেন বাংলার অভিজাত কন্যা রিয়াজ-উন-নেসাকে। রিয়াজ-উন-নেসা ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ২৪ পরগণার এক জায়গীরের উত্তরাধিকারী। চার্লস গ্রেগ তাঁদের দুই মেয়ের একজনের উত্তরসূরী। চার্লসের মায়ের নাম পামেলা স্টক। পামেলার বাবা টমাস স্টক ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ছিলেন। পামেলার মা ইনিদ ছিলেন ঔপনিবেশিক ভারতের নামকরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান জমিদার পরিবারের সন্তান। তাঁরা থাকতেন জেনারেল পামারের উত্তরাধিকারীদের বাসস্থান বিহারের পুর্ণিয়ায় পামার হাউসে। সিনিয়র পামারের কনিষ্ঠ সন্তান চার্লস পামার ১৮১১ সালে পামার হাউস নির্মাণ করেন। ১৯৫০ সালে ভারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হওয়া পর্যন্ত পরিবারটি বিহারের পুর্ণিয়াতেই ছিল।

২৪৩ বছর পর: নারিন্দা কবরস্থানে পূর্বপুরুষের সমাধিলিপি পড়ছেন চার্লস গ্রেগ
২৪৩ বছর পর: নারিন্দা কবরস্থানে পূর্বপুরুষের সমাধিলিপি পড়ছেন চার্লস গ্রেগ

চার্লস তাই আমার কাছে বিস্ময়। প্রথমত, ঢাকার সঙ্গে ইউরোপের এক প্রখ্যাত চিত্রকরের সম্পর্ক আবিষ্কার। দ্বিতীয়ত, বাংলা ও ভারতের যোগে সমন্বিত তাঁর বংশলতিকার কারণে তিনি এক অনন্য চরিত্র। তিনি শিল্প-ইতিহাসবিদ, লেখক, সংগ্রাহক, চিত্রসমালোচক ও চিত্রবিক্রেতা। তাঁর বাবার এক পুর্বপুরুষ ক্যাপ্টেন টমাস বরথউইক পলাশীর যুদ্ধের ১২ বছর পর ঢাকায় মারা যান। তাঁর কবর হয় নারিন্দার খ্রিষ্টান কবরস্থানে। কালের ধ্বংসলীলার পরেও তাঁর সমাধিলিপি আমরা খুঁজে পাই। ২৪৩ বছর পর পূর্বপুরুষের সমাধিলিপির সামনে দাঁড়িয়ে চার্লসের চিত্তচাঞ্চল্য স্পষ্ট টের পাওয়া গেল। হালে সমাধিলিপিটি স্থাপন করা হয়েছে কলম্বো সাহেবের সমাধিসৌধের ভেতরের দেয়ালে।
চার্লসের সুকৃতির অভাব নেই। সেগুলোর অন্যতম হলো ঢাকাকে বিষয়বস্তু করে আঁঁকা জোহান জোফানির বিস্মৃত শিল্পকর্ম দুটোর পরিচয় উদ্ঘাটন। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল সেন্টার ফর ব্রিটিশ আর্টে জোফানির বড় প্রদর্শনী হয়। মার্চ ২০১২-তে সেটি নিয়ে আসা হয় লন্ডনের রয়্যাল একাডেমিতে। এই প্রথম অন্যান্য শিল্পকর্মের পাশাপাশি গুরুত্বের সঙ্গে ঢাকার এই চিত্রকর্ম দুটো প্রদর্শন করা হয়।

বিহারের পুর্ণিয়ায় ১৭ কোঠার পামার হাউস, বর্তমানে পুর্ণিয়া কলেজ
বিহারের পুর্ণিয়ায় ১৭ কোঠার পামার হাউস, বর্তমানে পুর্ণিয়া কলেজ

২০১১ সালে লন্ডনের এক প্রদর্শনীতে লালবাগের চিত্রটিকে রবার্ট হোম নামে অন্য এক শিল্পীর চিত্রকর্ম হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। চার্লস ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হন, এটি অবশ্যই জোফানির আঁকা। হোমের মতো দুর্বল চিত্রকরের পক্ষে এমন উৎকর্ষ দেখানো বা এত দারুণভাবে ভারতীয় দেহাবয়ব ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ছিল না। আশ্চর্যের বিষয়, বিখ্যাত নিলাম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান সদবি’জ নিউইয়র্কে ও বিলেতে দুবার এই বিরল চিত্রকর্ম দুটো বিক্রির চেষ্টা করেও সফল হয়নি।
নারিন্দা-চিত্রটিকে পশ্চিমা শিল্পবোদ্ধারা উত্তর ভারতের কোনো জায়গার বলে ভেবেছিলেন। ঢাকা বা পূর্ব বাংলার কথা ঘুণাক্ষরেও কারও মাথায় আসেনি। চার্লস ‘নাগাপন ঘাট’ চিত্রে কলম্বো সাহেবের কবরটি সনাক্ত করেন। এটি তিনি করেন ব্রিটিশ লাইব্রেরির প্রকাশ করা বিরল এক ছবির সংগ্রহ থেকে। তাঁর এ উদ্ঘাটন ইয়োরোপের শিল্পজগতে সাড়া জাগায়। চার্লসই চিত্র দুটো কিনে নিয়ে এসে গবেষণাটি করেছিলেন। ইউরোপের বিশিষ্ট এক শিল্পীর সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ তিনিই খুঁজে বের করেন। প্রদর্শনীর কিউরেটরসহ সব বিশেষজ্ঞ এখন একমত, চিত্রকর্মগুলো অবশ্যই জোফানির। চার্লস গ্রেগের ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের কারণে এটি সম্ভব হলো। তাঁর কাছে এ ঋণ ঢাকাবাসীর।
২০১২ সালের ১০ মার্চ থেকে টানা ১০ জুন পর্যন্ত লন্ডনের রয়্যাল একাডেমিতে ‘জোহান জোফানি: সোসাইটি অবজার্ভ্ড্’-শীর্ষক এক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। সেখানে অসংখ্য দর্শক অপূর্ব এই ছবি দুটো দেখার সুযোগ পায়। তারা আরও দেখে, ছবি দুটোর নিচে উজ্জ্বলভাবে লেখা রয়েছে ঢাকা ও বাংলাদেশের নাম। চার্লস গ্রেগ বিশ্বে আমাদের নাম আরেকটু উজ্জ্বল করলেন।
অনূদিত ও সংক্ষেপিত