সাহসিকা সাকিরা সুজিয়া

মূল রচনা: দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে সাহসিকতার পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশের পুরস্কার। লন্ডন অলিম্পিকের মশাল ছিল তাঁর হাতে। ছিলেন ব্রিটিশ বাংলাদেশি প্রভাবশালীদের তালিকায়। পরিচিত হোন সাকিরা সুজিয়ার সঙ্গে

সাকিরা সুজিয়া
সাকিরা সুজিয়া

৬ আগস্ট ২০১১। লন্ডনে এক ভয়াল সন্ধ্যা। শহরের টটেনহাম এলাকায় এক তরুণের নিহত হওয়ার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে লন্ডন। শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা রূপ নেয় দাঙ্গায়। চারদিকে লুটপাট, গাড়িতে আগুন আর পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে লন্ডন হয়ে ওঠে আতঙ্কের নগর। ঘটনাস্থলে যাওয়ার জরুরি তলব আসে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ ও জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় দক্ষ পুলিশ সদস্যদের। খবর পেয়েই ছুটল প্রশিক্ষিত পুলিশ বাহিনী। পাঠক, আপনারা হয়তো টেলিভিশন বা সিনেমায় এমন দৃশ্য আকছার দেখে থাকবেন। কিন্তু ২০১১ সালের লন্ডনের এই সত্যি ঘটনা বাংলাদেশিদের কাছেও স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে পুরোপুরি ভিন্ন এক কারণে। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণকারী পুলিশ দলের পুরোভাগে ছিলেন এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণী। নাম সাকিরা সুজিয়া। চলুন আবার ফিরে যাই লন্ডনে সেদিনের ভয়াল সন্ধ্যায়। সাকিরা সুজিয়ার কাছ থেকেই শুনি সেই সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা।

সেদিন লন্ডন ছিল এক আতঙ্কের নগর
সেদিন লন্ডন ছিল এক আতঙ্কের নগর

লন্ডনে ভয়াল সন্ধ্যা
‘টটেনহামে গন্ডগোলের শুরুর দিকে সেখানে পর্যাপ্ত দাঙ্গা পুলিশ ছিল না। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমার ডাক আসে ঘটনাস্থলে যাওয়ার।
পরিস্থিতি তখন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। চারদিকে আগুন, লুটপাট আর পুলিশের ওপর বৃষ্টির মতো ঢিল ছোড়া চলছিল সমানতালে। আমার মনে হচ্ছিল, যেন যুদ্ধের ময়দানে কেউ আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। মাথায় হেলমেট, হাতে প্লাস্টিকের ঢাল থাকলেও নিজেকে খানিকটা অসহায় লাগছিল। কিন্তু আমরা ছিলাম মরিয়া। যে করেই হোক বিক্ষোভকারীদের পিছু হটাতে হবে।’
সাকিরার সঙ্গে আলাপের শুরু হয় সেদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে। সাকিরা বলে যান, ‘হঠাৎ রাস্তার পাশের দোকান থেকে এক তরুণ টেলিভিশন সেট ছুড়ে মারল আমাদের দিকে। নিজের কিছু হয়েছে কি না দেখারও সময় নেই। আমার চোখের সামনে দেখছি এক সহকর্মীর রক্তাক্ত মুখ। পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই কোনো। এই লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে আহত হওয়া

ফুটবল তারকা ডেভিড বেকহামের সঙ্গে
ফুটবল তারকা ডেভিড বেকহামের সঙ্গে

যাবে না কিছুতেই। রাস্তাজুড়ে লম্বা সারি তৈরি করলাম আমরা। শুরু হলো বিশৃঙ্খলকারীদের ধাওয়া। হুংকার দিয়ে এগোচ্ছি আর সমানতালে ধেয়ে আসছে ইট-পাটকেল, কাঠের টুকরা, ভাঙা কাচ। ওরা হাতের কাছে যা পাচ্ছে তা-ই ছুড়ে মারছে আমাদের দিকে। সামনে ধরে রাখা ঢাল থাকা সত্ত্বেও আহত হচ্ছেন সহকর্মীরা। প্রথম সারিতে সবাই দীর্ঘদেহী পুরুষ পুলিশ অফিসার আর আমিই একমাত্র পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতার। সেটা বরং সুবিধাই ছিল আমার জন্য। সেদিন পুরো দলে আমিই একমাত্র অক্ষত ছিলাম। পুরো সপ্তাহটা যে কীভাবে কেটেছে বলে বোঝানো যাবে না। পরিবারের সবার সঙ্গে যোগাযোগের সময়ও ছিল না সে সময়।’
সাকিরা এবং তাঁর সহকর্মীদের সহায়তায় প্রায় সপ্তাহব্যাপী দাঙ্গা অবশেষে থামে। যুক্তরাজ্যের নানা শহরে ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ। শান্ত হতে থাকে শহর লন্ডন। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে সাহসিকতার স্বীকৃতি হিসেবে ৩০ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে একসঙ্গে মেট্রোপলিটন কমিশনার পদক দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে মেট্রোপলিটন পুলিশে যোগ দেওয়া সাকিরা দাঙ্গাকালীন সামনের সারিতে থাকা অকুতোভয় পুলিশ হিসেবে এই পদক পান। তবে সাকিরার সাফল্য এখানেই শেষ নয়।

বাংলাদেশ সবসময় টানে সাকিরাকে
বাংলাদেশ সবসময় টানে সাকিরাকে

ম্যারাথন কন্যা
দৌড়প্রিয় সাকিরা কাকডাকা ভোরে জেগেই দৌড়ান। তাঁর ‘ম্যারাথন-প্রেম’ সম্পর্কে হেসে জানালেন, ‘আমি দৌড়াতে ভালোবাসি এবং সমাজের যেকোনো শুভ পরিবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়ে দৌড়ে অংশ নিতে আরও ভালো লাগে।’ ২০০৭ সালে লন্ডন ম্যারাথন দিয়েই সাকিরার শুরু। এ পর্যন্ত পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ ম্যারাথন এবং বেশ কয়েকটি হাফ ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন তিনি।
পূর্ব লন্ডনের স্যাডওয়েল এলাকায় বেড়ে ওঠা সাকিরার। ওয়েস্টমিনস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিদ্যা এবং অপরাধ বিষয়ে স্নাতক করেছেন। বললেন, ‘আমার বেড়ে ওঠার পথে নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমাদের এলাকায় অপরাধপ্রবণতা ছিল বেশি। সমবয়সীদের বিপথগামিতার মধ্যে নিজেকে বের করে নিয়ে আসাটাও ছিল কঠিন পরীক্ষার মতো। নানা অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সমাজের জন্য আশপাশের মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদেই পুলিশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার পেশা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মা-বাবা একটু বেশি চিন্তিত থাকেন। তবে আমাদের স্বপ্ন পূরণে তাঁদের প্রেরণাই পাথেয়।’
মা আজিজুন নেসা ও বাবা মোহাম্মদ আবদুল তাহিদ। তাঁরা সুনামগঞ্জের মানুষ। মা-বাবা মুখ উজ্জ্বল করেই সম্প্রতি ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার হানড্রেড তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন সাকিরা সুজিয়া।
সাকিরা সম্পর্কে ব্রিটিশ বাংলাদেশি এমপি রুশনারা আলী বলেন, ‘লন্ডন রায়টে তাঁর সাহসিকতা ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটির মুখ উজ্জ্বল করেছে। সাকিরা ব্রিটিশ বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের প্রেরণা।’
মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার স্যার বার্নার্ড হুগান সাকিরার অদম্য সাহসিকতায় মুগ্ধ। তাঁর মতে, ‘সাকিরা গুরুত্ব বুঝে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পটু। ও এমন একজন, যাকে নিয়ে লন্ডন পুলিশ গর্ব করতে পারে।’
২০১০ সালে বাংলাদেশে আসার সুযোগ হয়েছিল সাকিরার। শিকড়ের টানেই হয়তো বাংলাদেশ সব সময় তাঁকে কাছে টানে। সাকিরা বললেন, ‘২০১০ সালে ব্র্যাকের হয়ে ন্যায়পরায়ণতা ও জেন্ডারবৈষম্য নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে যাই। মাঠকর্মের অংশ হিসেবে অনেক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছি। যেখানকার মানুষের নির্মল ভালোবাসা কোনো দিন ভোলার নয়। প্রত্যন্ত গ্রামের মহিলারা আমাকে দেখে অবাক হন, কী করে আমি মেয়ে হয়ে পুলিশ হলাম। আমার উপলব্ধি, বাংলাদেশের নারীরাই দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। গ্রামের নারীরা সমানতালে পরিবারের আয় বাড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন পুরুষের সঙ্গে। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের সাহস, জীবনীশক্তি এবং সময়ের সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমার বিশ্বাস, অনেক দূর এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।’
লন্ডন অলিম্পিক

লন্ডন অলিম্পিক
লন্ডন অলিম্পিক

লন্ডন অলিম্পিকের মশাল শোভাযাত্রা নিরাপত্তা দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন সাকিরা সুজিয়া। নিজেও দৌড়েছেন অলিম্পিকের মশাল হাতে। অলিম্পিকের ইতিহাসে কীভাবে যুক্ত হলেন সাকিরা? সাকিরা বললেন, ‘২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিক শিখা লন্ডন আসে। আমার বোন রোকেয়া শিখাবাহক হিসেবে তার স্কুল থেকে মনোনীত হয়। তখন আমি প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকায় আবেদন করতে পারিনি, সে জন্য সব সময় আফসোস ছিল। জীবদ্দশায় এমন সুযোগ কি বারবার আসে? তবে ব্যস্ততার মধ্যেও লন্ডন অলিম্পিক ২০১২-এর আবেদন করতে ভুলিনি। মনোনয়নের ছিল দীর্ঘ প্রক্রিয়া। স্বপ্ন সত্যি হয়। অলিম্পিকের শিখা বহনকারীদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত একজন দৌড়বিদ হিসেবেও নির্বাচিত হই, যা ছিল বিস্ময়কর এবং কঠিন। দীর্ঘদিন ধাপে ধাপে চলে মনোনয়ন-প্রক্রিয়া। একটা ধাপ পার হলাম তো পরের ধাপের জন্য নিজেকে তৈরি করা। আমার ম্যারাথনের অভিজ্ঞতা খুব কাজে লেগেছে। অলিম্পিক মশালের নিরাপত্তা দিতে ৭০ দিন কাজ করেছি।’
গ্রিসের এথেন্স থেকে ব্রিটেনের মাটিতে অলিম্পিক শিখা পৌঁছানোর পর থেকে শুরু হয় সাকিরার ছুটে চলা, যা শেষ হয় লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী শিখা প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে। কেমন ছিল অলিম্পিক শিখা নিয়ে ছুটে চলার দিনগুলো?
‘প্রতিদিন ভোর চারটা থেকে শুরু করে রাত অবধি ছুটেছি। এখন নিজেই ভাবতে গিয়ে অবাক হই, কী করে তা সম্ভব হলো! অলিম্পিক শিখার নিরাপত্তা দিতে গিয়ে অনেক খ্যাতিমান মানুষের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়। বলিউড অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন ও প্রিয় ফুটবলার ডেভিড বেকহামের সঙ্গে সাক্ষাৎ খুব আনন্দের ছিল। প্রতিটা দিন ছিল বৈচিত্র্যময়।’

সাকিরা সুজিয়া
সাকিরা সুজিয়া