মার্কেস-শূন্য হলদে এপ্রিল

১৭ এপ্রিল পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন দশদিগন্ত মাতানো লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। চলে গিয়ে আরও বিপুলভাবে ফিরে এলেন সবার অন্তরে। কেমন ছিল সবার প্রিয় এই লেখকের শেষ দিনগুলো?

‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’। টিএস এলিয়টের কবিতার চরণের সঙ্গে মনে পড়ছে এ মাসেই ভুবন থেকে বিদায় নিয়েছেন গাব্রিয়েল হোসে দে লা কোনকোর্দিয়া গার্সিয়া মার্কেস
‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’। টিএস এলিয়টের কবিতার চরণের সঙ্গে মনে পড়ছে এ মাসেই ভুবন থেকে বিদায় নিয়েছেন গাব্রিয়েল হোসে দে লা কোনকোর্দিয়া গার্সিয়া মার্কেস

‘মোরিরসে এস মুচো মাস দিফিসিল দে লো কে উনো ক্রেয়ে’
(তুমি যা ভাবছ, মৃত্যু তার চেয়েও কঠিন)
সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ, অধ্যায় ৯

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের প্রিয় রং ছিল হলুদ। স্বদেশ কলম্বিয়ার ক্যারিবীয় উপকূলে ১৭ এপ্রিল দুপুরবেলা তাঁর প্রিয় হলুদ আলো ঠিকরে পড়ার সময় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মেহিকো সিটির দক্ষিণ অংশের এল পেদ্রেগাল আবাসিক এলাকার কাইয়ে ফুয়েগো সড়কের বুগেনভেলিয়ায় আচ্ছাদিত ১৪৪ নম্বর ঠিকানার নিজ বাসায়। খুব রোদেলা একটা দিন ছিল, সেটা ছিল ক্যাথলিক খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের সান্তো হুয়েবেস বা হোলি থার্সডে, আর তিন দিন পরেই ইস্টার সানডে। ছুটির কারণে শহরটা প্রায় ফাঁকা। এ শহরেরই একটি ঘরে নিজেকে ১৮ মাস বন্দী রেখে ভূতগ্রস্তের মতো লিখেছিলের বিশ্বের প্রথম গ্লোবাল উপন্যাস সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ (নিঃসঙ্গতার এক শ বছর)। এ শহরেই তিনি বাস করেছেন গত ৫ দশক। দুপুর ১২টা ৮ মিনিটে (আমাদের দেশে তখন রাত ১১টা ৮ মিনিট) চিরদিনের জন্য খুব শান্তভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। তাঁর শিয়রের কাছে তখন ছিলেন স্ত্রী মের্সেদেস, সস্ত্রীক দুই ছেলে রোদ্রিগো আর গোন্সালো ও পাঁচ নাতি-নাতনি। তাঁর শব দাহ করা হয় পরেরদিনই, পারিবারিক ব্যবস্থায়, খুব গোপনে।
কেন জানি মনে হয়, গাবো (মার্কেসকে গাবো নামেও ডাকা হতো) জানতেন তিনি চলে যাবেন। নিজের মৃত্যুর পূর্বাভাস তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর সহজাত জ্ঞান আর ভাবীকথনের কথা বিশ্ববিশ্রুত। তাঁর পরিবারের অনেকেরই এই গুণটি ছিল। আগে থেকে বলে দিতে পারতেন কী হবে। এ কারণেই কি নয় দিন ইনিস্ততুতো নাসিয়োনাল দে সিয়েন্সিয়াস মেদিকোস ই নিউত্রিসিয়োন সালবাদোর সুরবিরান হাসপাতালে থাকার পর অসুস্থতা নিয়েই বাড়ি ফেরা? ৩১ মার্চ এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ব্রংকাইটিস আর ডিহাইড্রেশনের সমস্যা নিয়ে। ওই কদিন সারা দিনই মিডিয়া জড়ো হয়ে ছিল হাসপাতালের সামনে। হঠাৎ এমন কী হলো যে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো? ৬ মার্চ তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে উপস্থিত সবার সঙ্গে গেয়েছেন জন্মদিনের গান, প্রীতিভরে নিয়েছেন ফুলেল শুভেচ্ছা। একপর্যায়ে হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষমাণ মিডিয়াকে জানানো হলো, গাবো স্বভাবসুলভ রসিক ভঙ্গিতে তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তোমরা যাও, কাজে যাও, পাগলের মতো দাঁড়িয়ে থেকো না এখানে।’ পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হলো, তিনি দু-চার দিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরবেন।
বাড়ি তিনি ফিরলেন ঠিকই। তাঁকে আনা হলো অ্যাম্বুলেন্সে, কেউ দেখল না তাঁর মুখ, তাঁর সঙ্গে বাড়িতে ঢুকল স্পেশালাইজড বেড, যেমনটা হাসপাতালের আইসিইউতে থাকে। মিডিয়ায় খবর এল, মার্কেসের শরীরে আবার কর্কটরোগ সংক্রমিত হয়েছে: তাঁর ফুসফুস, যকৃৎ আর স্নায়ুতন্ত্রে ছড়িয়ে পড়েছে ক্যানসার। অবস্থা জটিল কিন্তু তাঁর পরিবার একেবারে চুপ, ঘনিষ্ঠজনেরাও কিছু বলছেন না এ বিষয়ে। ১৯৯৯ সালে গাবোর শরীরে লিম্ফ্যাটিক ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর তিনি চিকিৎসা নেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে, যে শহরে তাঁর বড় ছেলে সিনেমাটোগ্রাফার রোদ্রিগো থাকেন। সুস্থ হয়ে আবার কর্মজীবনে ফিরে আসেন মার্কেস। তখনো ওই রোগ নিয়ে তাঁর পরিবারের তরফ থেকে তেমন কিছু জানা যায়নি।
২০০৬ সালের ২৯ জানুয়ারি বার্সেলোনার দৈনিক লা বানগুয়ার্দিয়ার সাংবাদিক শাবি আয়েনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে (সম্ভবত শেষ সাক্ষাৎকার) গ্যাবো জানান, ‘লেখালিখি ছেড়ে দিয়েও আমার জীবন চলছে।’ কীভাবে চলে? গল্প বলার জন্যই যাঁর বেঁচে থাকা, তিনি না লিখে থাকেন কীভাবে? গাবোর লেখালেখির প্রাথমিক রসদ ছিল তাঁর স্মৃতি, নস্টালজিয়া। খবরে প্রকাশ, তাঁর আলজেইমার বা স্মৃতিভ্রষ্টতা হয়েছে, যদিও কোনো ডাক্তারি পরীক্ষাসূত্রে সেটা জানা যায়নি। তিনি ছিলেন এমন একজন, যাকে তাঁরই ভাষায় বলা যায় ‘পেশাদার স্মৃতিচারণকারী’। তাঁর পরিবারে ছিল মাইল্ড কোগনিটিভ ইমপেয়ারমেন্ট—স্মৃতিহীনতা রোগ। সেটা তাঁকেও ছাড় দেয়নি। স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে স্মৃতিজাগানিয়া সব ব্যক্তিগত আর পারিবারিক কাহিনিকে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে চমৎকার আখ্যানে রূপান্তরিত করতে যাঁর বাহাদুরি, তিনিই অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছেন, অনেককে চিনতে পারছেন না!
লেখক মার্কেস আর ছিলেন না প্রত্যক্ষে, কিন্তু তবু তো ছিলেন। থাকা আর না থাকায় অনেক তফাত। একবার এক সাক্ষাৎকারে মৃত্যু প্রসঙ্গে

বলেছিলেন, ‘লো মালো দে লা মুয়ের্তে এস কে এস পারা সিয়েম্প্রে’ (মৃত্যুর বাজে দিকটি হলো, ও চিরদিনের জন্য ঘটে’)। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অমরত্ব পেলেন গাবো। ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’। টিএস এলিয়টের কবিতার চরণের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ছে এ মাসেই ভুবন থেকে বিদায় নিয়েছেন শেক্সপিয়ার আর সের্বান্তেসের মত দিকপালরা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন গাব্রিয়েল হোসে দে লা কোনকোর্দিয়া গার্সিয়া মার্কেস। তাঁর বিদেহী আত্মার স্মরণে চলুন গিয়ে হাজির হই আরাকাতাকায়, তাঁর বালকবেলার বাড়িটির সামনে এক গোছা হলদে গোলাপ হাতে পড়ি রবীন্দ্রনাথের পূরবী কাব্যগ্রন্থের ‘কৃতজ্ঞ’ কবিতার শেষ চরণটি: ‘সব চেয়ে মানি তুমি ছিলে একদিন’।