নতুন করে সামনে চলো: জেমস ক্যামেরন

জেমস ক্যামেরন। বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা। তাঁর প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রই নির্মাণশৈলী ও ব্যবসা-সফলতার ক্ষেত্রে ইতিহাস গড়েছে। টারমিন্যাটর-২ (১৯৯১), টাইটানিক (১৯৯৭) কিংবা অ্যাভাটার (২০০৯)-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। ক্যামেরন ১৯৫৪ সালের ১৬ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নাসার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। তিনি ২০০৫ সালে অ্যামেরিকান ইনস্টিটিউট অব অ্যারোনাটিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনাটিকসের প্রথম মহাকাশ অভিযান সম্মেলনের সমাপনীতে এই বক্তব্য দেন।

জেমস ক্যামেরন
জেমস ক্যামেরন

সবাইকে স্বাগত। আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আমি নভোচারীদের মতো মহাকাশে বসবাস নিয়ে কাজ করি না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমি মহাকাশ গবেষণা নিয়ে অনেক আগ্রহী। আমার মস্তিষ্ক ও হূদয়ের পুরোটা জুড়ে ছিল তখন মহাকাশ। ছোটবেলায় আমি মহাকাশ নিয়ে যতটা উত্তেজিত থাকতাম, ঠিক এই মুহূর্তে সেই উত্তেজনা এখনো আমার মধ্যে ভর করে আছে। আমি মহাকাশবিশারদ নই, কিন্তু মহাকাশে মানুষের অভিযান নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। আমি সেই স্বপ্নের কথাই জানাতে চাই আপনাদের।
বছর কয়েক আগে খেয়াযান কলম্বিয়ার দুর্ঘটনা ঘটে, যা আমাদের মহাকাশে বসবাসের স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, সেই দুর্ঘটনা আমাদের জন্য একধরনের স্বপ্ন দেখার প্রেরণাও বটে। এর আগেও অনেকগুলো মহাকাশযান দুর্ঘটনা আমাদের স্বপ্নগুলোকে বাধাগ্রস্ত করেছে। কিন্তু প্রতিবারই আমরা মানুষ নতুন করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিই। আমরা আবারও নতুন খেয়াযান তৈরি করে মহাকাশে যাই। অতীতের দুর্বলতাকে কাটিয়ে এগিয়ে যাই সামনের দিকে। এটাই তো মানবধর্ম।
আমরা শত ঝুঁকি নিয়ে মহাকাশে নভোচারীদের আমাদের মানবসভ্যতার প্রতিনিধি হিসেবে পাঠাই। আমাদের মাথায় অনেক হিসাব থাকে। সেই নভোচারীদের জীবন, খেয়াযান আর প্রতিটি মুহূর্তের দাম তখন কোটি কোটি ডলার। ছোট একটা ভুলেই সব ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমরা সেই ঝুঁকি মাথায় নিয়েই মহাকাশ অভিযানের স্বপ্ন দেখি। আমাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অদূর ভবিষ্যতে কি আমরা রোবটদের মহাকাশে পাঠাব?
আমি নাসার উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য। তাই খেয়াগবেষণা নিয়ে কী রকম চিন্তা-বিচিন্তা করতে হয়, সেটা বেশ ভালোভাবেই জানি। এটাকে চিন্তা না বলে, দুশ্চিন্তার বড় কিছু থাকলে সেটাই বলা উচিত। একেকটা দুর্ঘটনা আমাদের নিজেদের ওপরেই বিশ্বাসের ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। কলম্বিয়া খেয়া দুর্ঘটনা ছিল তেমনই। কিন্তু আমরা হতাশ হইনি। আজ সূর্য ডুবলে তো কাল উঠবেই।
আমরা মনে মনে একটাই প্রতিজ্ঞা নিই। পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। সামনে চলো। লাল গ্রহ মঙ্গলের বুকে ছুটে চলা একেকটি রোভার যেন আমাদের মানবজাতির স্বপ্ন। এই রোভারগুলো শুধু আমাদের স্বপ্নই বাঁচিয়ে রাখে না।
আমাদের মানুষের জ্ঞান আর জানাশোনা জীবকুলের মধ্যে কতটা উত্তম, সেটাই প্রকাশ করে। আমাদের রোবটিক প্রতিনিধি রোভারগুলো অন্য গ্রহের রহস্য উন্মোচন করে চলেছে। রোভারগুলো ভবিষ্যতে মানুষের পায়ের ছাপ কোথায় রাখবে, সেটাই নির্দেশ করার কাজ করে চলেছে। ধূলিমাখা সেই গ্রহের যান্ত্রিক চাকার ছাপ পড়া পথেই তো একদিন মানবজাতি হেঁটে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখে। লাল গ্রহ মঙ্গলের গায়ে এখন এলিয়েন গ্রহের তকমা নেই। মঙ্গলই হবে আমাদের আগামীর গ্রহ। সাধারণ মানুষ যারা মহাকাশের গোপন রহস্য বোঝে না, তারাও আজ মঙ্গলে মানুষের প্রতিনিধি দেখে খুশি হয়। কল্পনা যে তাদের চোখের সামনে এখন বাস্তবতা।
চন্দ্রজয় আমাদের মানবসভ্যতার অনন্য একটি ঘটনা। অ্যাপোলো ১১ খেয়াযানের সেই মিশন ছিল আমাদের স্বপ্ন ছোঁয়ার সংগ্রাম। পরিত্যক্ত এক উপগ্রহে ছিল প্রাণসঞ্চারণের এক ভয়াবহ ও দুঃসাহসী সেই মিশন। সবকিছুর একটা ভালো শুরু লাগে। গত শতকের পঞ্চাশ দশকে রাশিয়ানরা মহাকাশে স্ফুতনিক পাঠাল। ইউরি গ্যাগারিন প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশ অভিযানের সূচনা করলেন। সেই যে শুরু হলো। এখন আমরা স্বপ্ন দেখি মঙ্গলে মানুষ যাবে। আমাদের এই লক্ষ্য পূরণ করতেই হবে।
মানুষ স্বপ্ন দেখত আকাশ ছোঁয়ার। সেই ক্ষুদ্র মানুষগুলোর এখন স্বপ্ন-মহাকাশে বসবাস। ব্রুকলিন ব্রিজের নকশাকার জোহান রোয়েবলিং তাঁর

সৃষ্টিকর্ম সেই ব্রিজ সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, কোনো মানুষই এই ব্রিজকে স্বপ্নে দেখেনি। আর যখন স্বপ্ন পূরণ হলো, তখন তারা এই ব্রিজকে দেখে বুক ফুলিয়ে মানবসভ্যতার জয়গান গেয়েছে। আমাদের মহাকাশ গবেষণায়ও এমনটি হচ্ছে। ১৫ বছর বয়সে আমি নীল আর্মস্ট্রংকে টিভির পর্দায় চন্দ্রে পা রাখতে দেখি। নীল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিনকে দেখে আমার কান্না চেপে রাখতে পারিনি। চন্দ্রবুকে তাঁদের পদচিহ্ন তো আমারই পায়ের ছাপ। আমার মতো শতকোটি মানুষের আবেগ ছিল এমনই। আমার নিজেকে মানুষ হিসেবে তখন অনন্য মনে হয়েছিল। খেয়াযান যখন অগ্নস্ফুিলিঙ্গ ছুটিয়ে ধেয়ে যায় মহাকাশপানে, তখনকার অনুভূতি কী অসাধারণ নয়? যাঁরা সামনাসামনি খেয়াযানের উড্ডয়ন দেখেছেন, তাঁরা জানেন, ৯, ৮, ৭, ৬ করে যখন ০ বলে ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে খেয়াযান ছুটে যায়, তখন বুকের মধ্যে কেমন অনুভূতি হয়। সারা শরীরে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে যায়। আমরা মানুষ কত কিছুই না পারি!
স্বপ্ন দেখতে দোষ কোথায়? মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন কি একজনে দেখে? কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন এটি। মহাকাশ অভিযান কোনো একক স্বপ্ন নয়। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের বর্ণনা এক মুহূর্তে কি দেওয়া সম্ভব। মানুষের উদ্ভাবনী দক্ষতা প্রকাশের এক অনন্য ক্ষেত্র হলো মহাকাশ গবেষণা। অজানা কোনো গ্রহে দাঁড়িয়ে একজন নভোচারীর কৌতূহলী দৃষ্টিই তো আমার দৃষ্টি, আমাদের চোখই তো সেই চোখ। সেই নভোচারীর কণ্ঠ তো আমারই কণ্ঠ। আমি সেই নিঃসঙ্গ গ্রহে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকব, আমি অন্ধকারকে ভয় পাই না। আমি সামনে অজানা যা দেখছি, তা বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমি ভীত নই। এই রহস্য আমি উন্মোচন করবই। অজানাকে জানার এই মনোমুগ্ধ রহস্য আর সৌন্দর্যকে দেখার জন্যই তো জন্ম আমার, আমাদের।
ভাস্কো দা গামা, ম্যাজেলান, কুকদের মতো অভিযাত্রীদের কল্যাণে সে সময়কার মানুষ অনেক নতুন কিছু জানতে পারত। তারা ঘর থেকে বেরিয়ে ছিলেন বলেই পৃথিবীবাসী উপকৃত হয়েছে। তাঁদের অভিযানগুলোর সাফল্য আর ব্যর্থতা নিয়েই তো আমাদের ইতিহাস। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের অনন্য এক উৎকর্ষ সময়ে বসবাস করছি। মহাকাশ অভিযান এখন বিলাসিতা নয়। আমাদের এখনকার সভ্যতার আদর্শ এটি। আগে মানুষ সমুদ্রে যেত অভিযানে, এখন মহাকাশে। সময় এগিয়ে যায়, মানুষের জ্ঞান অন্বেষণের ক্ষুধাও বেড়ে যায়। তাই তো বসে থাকলে চলবে না। আগে বাড়ুন! শত বাধাকে পাশ কাটিয়ে আগে যেতে হবেই।
তো আমরা বসে আছি কেন? মানবসভ্যতার মঙ্গল অভিযান মঙ্গল হোক। চলুন সবাই সেই অভিযানে। ধন্যবাদ সবাইকে।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: জাহিদ হোসাইন খান