বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অনেক সম্ভাবনা

বাংলাদেশ সফরে সার্ন-এর মহাসচিব জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী রালফ ডিটার হয়্যার। ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশ সফরে সার্ন-এর মহাসচিব জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী রালফ ডিটার হয়্যার। ছবি: প্রথম আলো

ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্য উদ্ঘাটন নিয়ে কাজ করেন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী রালফ ডিটার হয়্যার। মহাবিশ্ব কী দিয়ে তৈরি? শুরুতে দেখতেই বা কেমন ছিল তার রূপটা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতেই কাজ করছে হয়্যারের প্রতিষ্ঠান সার্ন, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও প্রসিদ্ধ পদার্থবিদ্যা গবেষণাগার হিসেবে পরিচিত। ২০১২ সালের জুলাইতে সার্ন ঘোষণা দিয়েছিল হিগস বোসন বা ঈশ্বর-কণার অস্তিত্ব। এ কণা মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য উন্মোচনের অনেক বিষয় সমাধান করতে পারে। এ ছাড়া ২০১৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পাওয়া ফ্রাসোয়াঁ ইংলাখত ও পিটার হিগসের ‘লার্জ হার্ডন কলাইডারের’ গবেষণাটিও চালানো হয় সার্নে। তাই দুই বছর ধরে সার্নকে নিয়ে জগৎজুড়েই তুমুল আলোচনা।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ অভিযানের পর থেকেই বিপুলসংখ্যক তরুণের মধ্যে প্রকৌশলবিদ্যা পড়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ঈশ্বর-কণার অস্তিত্ব জানান দেওয়ার পর থেকেই সারা বিশ্বের কৌতূহলী দৃষ্টি সার্নের দিকে। তবে মজার বিষয়টা হচ্ছে, সার্ন নিয়ে যেখানেই কথা বলতে গেছেন, বিজ্ঞানকে প্রাত্যহিক জীবনাচারের অংশে পরিণত করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন সার্নের মহাপরিচালক রালফ ডিটার হয়্যার। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা সফরের সময় একই সুর অনুরণিত হয়েছে তাঁর কণ্ঠে।
এর পেছনে যুক্তিটা কী? রালফের উত্তর: ‘অনেকেই বলে থাকেন বিজ্ঞানে তাঁদের আগ্রহ নেই। প্রয়োজনের সবটাই যে তাঁদের আছে!

অথচ সবকিছুর মূলেই রয়েছে বিজ্ঞান। যদি কোনো মৌলিক বিজ্ঞান না থাকে, তবে কোনো প্রায়োগিক বিজ্ঞানের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। ২৩ বছর আগে সার্নে সৃষ্টি হয়েছিল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (www)। এ ঘটনা পৃথিবীজুড়েই এনেছে নাটকীয় পরিবর্তন। তাহলে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই তো বিজ্ঞানের সঙ্গে হাত ধরেই আমরা চলছি।’
গড পার্টিকল বা ঈশ্বর-কণা যে বিশেষ জাতের সেটি প্রথম বলেছিলেন বাঙালি পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাই প্রথম ওই কণাটির অস্তিত্ব কল্পনাকারী ব্রিটিশ পদার্থবিদ পিটার হিগস। হিগস ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে নিয়ে এর নামকরণ হয়েছে হিগস বোসন। তাই বাংলাদেশ সফরের সময় রালফ বললেন, বিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণাই পাল্টে দিতে পারে দেশকে। অকপটেই রালফ স্বীকার করলেন, দেশে-দেশে এখন বাজার তর-তর করে জীবিকায় সাফল্য আসবে এমন বিষয়েই পড়াশোনায় আগ্রহটা গড়ে তুলতে হবে। কাজটা করতে হবে শৈশবেই।
এ নিয়ে জীবনের দুটি পর্বে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুললেন জার্মান এ বিজ্ঞানী। রালফ তো মনে করেন, স্কুলের সেই বিজ্ঞান শিক্ষকই তাঁর মাঝে আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছিলেন। তা না হলো তো তাঁর পদার্থবিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব হতো না। তেমনি সার্নের শিক্ষাসফর কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শিশু-কিশোরদের কথা বলে বুঝেছেন, আবিষ্কার তাদের কতটা উদ্দীপিত করেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার পর তাদের আগ্রহ তাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের রয়েছে অনেক সম্ভাবনা। তাঁদের জন্য গবেষণার ক্ষেত্রটা তৈরি করে দেওয়া জরুরি।
রালফের ঢাকা আসাটা এবারই প্রথম সার্নের কোন শীর্ষ কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফর। বাংলাদেশের কাছে সহযোগিতার হাতটা বাড়ানোই এ সফরের অন্যতম লক্ষ্য। যেহেতু উন্নততর বিজ্ঞান শিক্ষা কিংবা গবেষণায় বাংলাদেশ ততটা পথ পাড়ি দেয়নি, কাজটা ধাপে ধাপে করার পক্ষে রালফ ডিটার হয়্যার। শুরুতে বিজ্ঞান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, কর্মশালা এবং সার্নের গ্রীষ্মকালীন কর্মসূচিতে বাংলাদেশের

একজন শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ—এ ছক নিয়েই তিনি এগোতে চান। তাঁর ভাবনায় রয়েছে যৌথ গবেষণার বিষয়টিও।
রালফ জানান, সার্ন প্রতি বছর সারা বিশ্বের তিন হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০০ শিক্ষার্থীকে গ্রীষ্মকালীন কর্মসূচিতে গবেষণার সুযোগ দেয়। দুই মাসের এ শিক্ষা কর্মসূচিতে একজন শিক্ষার্থী একটি নির্দিষ্ট প্রকল্প নিয়ে গবেষণার সুযোগ পান সার্নের সুইজারল্যান্ড কিংবা প্যারিসের গবেষণাগারে। এবার বাংলাদেশের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ সুযোগ পাচ্ছেন। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখতে চায় সার্ন। বিজ্ঞানশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে এ বছরের শেষ দিকে ঢাকায় একটি কর্মশালারও আয়োজন করবে সার্ন।
সার্নের মহাপরিচালক জানান, কর্মশালায় উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের তাঁদের আধুনিক পদার্থবিদ্যার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পরে প্রশিক্ষিত এসব শিক্ষকই অন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন, এর মাধ্যমে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে।
বিজ্ঞানকে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বিবেচনা করেন রালফ ডিটার হয়্যার। কারণ, বিজ্ঞানের মাধ্যমে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের মানুষকে এক সুতোয় বাঁধা সম্ভব।