বাংলাপ্রেমী এক সাহেব
তিনি ছিলেন ইংরেজ৷ পেশাগত জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন বাংলায়৷ তাঁর শেষ কর্মস্থল ছিল ঢাকা৷ ১৯৬৬ সালে অবসর নিয়ে ফিরে যান নিজ দেশ ইংল্যান্ডে৷ এরও অনেক পরে পিতার কর্মস্থল ঢাকায় এলেন তাঁর ছেলে ফিলিপ৷ বের হলো স্টিফেন বেনেডিক্ট হ্যাচ-বার্নওয়েল নামের আইসিএস কর্মকর্তার আত্মজীবনী
সাদা ঢোলা হাফ শার্ট, ব্যাগি হাফ প্যান্ট ও মাথায় ব্রিটিশরাজের চিহ্ন সানহ্যাট। সাইকেলে ধীরে ধীরে চলছেন তিনি—স্টিফেন বেনেডিক্ট হ্যাচ-বার্নওয়েল—এই ইংরেজ ‘সাহেব’টিকে প্রথম দেখেছিলাম ১৯৬১ সালের এক গ্রীষ্মের দুপুরে, ঢাকায়। মনোরম, শান্ত ও খানিকটা ঝিম ধরা পরিবেশ। উইলিস জিপে করে স্কুল শেষে আমাকে ও আমার বোনকে জিপে তুলছেন আমার আব্বা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন খান। সে সময় ঢাকা শহরে গাড়ির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকা তখনো নিজের নামের প্রতি সুবিচার দেখানোর মতো অবস্থায় আসেনি।
সেই তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। গাড়ি থেকে নেমে ওই ইংরেজ সাহেবকে সম্ভাষণ জানালেন আব্বা। সাইকেল থেকে নেমে তিনিও প্রত্যুত্তর দিলেন। পরে শুনেছি, ওই সাইকেলই হচ্ছে তাঁকে চেনার উপায়। কিছুক্ষণ বাদে আব্বা ডাকলেন আমাদের। পরিচিত হলাম তাঁর সঙ্গে। দীর্ঘদেহী সেই ইংরেজ ভদ্রলোক করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। মনে হলো, সেটি পৃথিবীর দীর্ঘতম হাত। যখন নিজের হাত দিয়ে আমার ছোট্ট হাতটি ধরলেন তিনি, তার মধ্যে হারিয়ে গেল আমার হাত।
ইংরেজ রাজ কর্মকর্তারা রাশভারী—তখনকার দিনে সাবেক ইংরেজ রাজ কর্মকর্তাদের সম্পর্কে ধারণা ছিল এ রকম। কিন্তু তিনি তেমন ছিলেন না। তাঁর ব্যবহারের মধ্যে ছিল স্বভাবজাত এক উষ্ণতা। হাসিখুশি এই ইংরেজ ছোটদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপতেন। মিশুক, বন্ধুবৎসল ও রসিক মানুষ বলেই মনে হতো তাঁকে। মনে পড়ে, প্রথম সাক্ষাতে তাঁর উচ্চতা দেখে যেমন কিছুটা ভড়কে গিয়েছিলাম, তেমনি মাথার হ্যাট দেখেও চমকিত হয়েছি। মনে আছে, এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে সেদিন তাকিয়ে ছিলাম।
স্টিফেন বেনেডিক্ট হ্যাচ-বার্নওয়েল ছিলেন সেই ইংরেজ সাহেব, যিনি ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে (আইসিএস) তিনি যোগ দিয়েছিলেন ১৯৩৩ সালে। চমকপ্রদ বিষয় হলো, পেশাগত জীবনের বড় অংশই তিনি কাটিয়েছেন বাংলায়। ১৯৪৩-৪৪ সালে তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট। খুব অল্প সময়ের জন্য মালদায় থাকলেও মানবিক গুণের কারণে তাঁর কথা সেখানকার মানুষ মনে রেখেছিল বহু দিন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তিনি আত্তীকৃত হন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি)। এরপর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারে কাজ করেন দীর্ঘদিন। অবসর নিয়ে নিজ দেশ ইংল্যান্ডে ফিরে যান ১৯৬৬ সালে।
স্টিফেন হ্যাচ-বার্নওয়েল সম্পর্কে প্রথম জেনেছি আব্বার কাছে। পরবর্তীকালে আরও অনেকের কাছে শুনেছি তাঁর কথা।
আব্বার সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪৪ সালে, কলকাতায়। তখন আব্বা ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করে সরকারি সিভিল সাপ্লাইজ বিভাগে যোগ দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে চাকরিজীবনে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তাঁদের অনেকবারই দেখা হয়েছে। তাঁর ছেলে ফিলিপ হ্যাচ-বার্নওয়েলের জন্মও এই ঢাকা শহরেই।
স্টিফেন হ্যাচ-বার্নওয়েলের কাহিনি এখানেই শেষ হয়ে যেত পারত, যদি না ২০০১ সালে তাঁর ছেলে ফিলিপ হ্যাচ-বার্নওয়েল তাঁর পরিবার নিয়ে বাবার স্মৃতিজড়িত ঢাকা শহরে পা রাখতেন এবং আমার সঙ্গে তাঁদের দেখা না হতো। পত্রিকায় খবর পেয়ে ওই সময় ফিলিপের সঙ্গে দেখা করি। ফিলিপ তখন ধর্মান্তরিত হয়ে তাতিক নামে এক ইন্দোনেশীয় মুসলমান নারীকে বিয়ে করেছেন। তাঁদের তিনটি সন্তান—চার্লস, হেলেন ও অলিভার।
ঢাকা শহরে আছে ফিলিপেরও শৈশবের কিছু অংশ। তাঁর পিতার কর্মজীবনের শেষ সময়টিও কেটেছে এখানে। এই সফরে ফিলিপ তাই পিতা ও তাঁর ফেলে যাওয়া জীবনকেই খঁুজে ফিরেছেন। সেই সঙ্গে নিজের পরিবারকেও শরিক করতে চেয়েছেন সেই অভিজ্ঞতার।
এই সফরে তিনি ঢাকা ক্লাবে গিয়েছেন। ১৯৩৬ সালে ঢাকা ক্লাবের সদস্য হয়েছিলেন তাঁর বাবা। ক্লাবটিকে ঘিরে ফিলিপের নিজেরও রয়েছে অনেক স্মৃতি।
তাঁর বাবার পরিচিত বা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, এমন অনেকের কাছে ফিলিপকে নিয়ে গিয়েছি। আমার আব্বা অসুস্থ হলেও সাদর সম্ভাষণ জানান ফিলিপকে। তাঁর কাছে মেলে ধরেন তাঁর বাবার স্মৃতি। সে সময় ফিলিপ তাঁর কাছে নানা প্রশ্ন করে প্রয়োজনীয় নোটও নেন।
যাওয়ার আগে ফিলিপ জানান, লন্ডনে তাঁর বাবার একটি অপ্রকাশিত আত্মজৈবনিক পাণ্ডুলিপি আছে। ভালো প্রকাশক পেলে তিনি এটি প্রকাশ করতে ইচ্ছুক। তাঁর এ কথায় আমারও আগ্রহ জেগে ওঠে। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের মহিউদ্দীন আহমেদের কাছে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলে তিনিও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফিলিপকে পাণ্ডুলিপিটি পাঠাতে অনুরোধ করার কিছুদিন পরই হাতে এসে পৌঁছায় একটি প্যাকেট। পাণ্ডুলিপির সঙ্গে ফিলিপ তাঁর বাবা-মায়ের অ্যালবাম থেকে বেশ কিছু চিত্তাকর্ষক ছবিও পাঠিয়ে দেন।
২০১১ সালে ইউপিএল থেকে খালিদ শামস ও ফখরুল আলমের সুসম্পাদনায় বেরোয় দ্য লাস্ট গার্ডিয়ান মেমোয়ার অব হ্যাচ-বার্নওয়েল আইসিএস অব বেঙ্গল নামের বইটি। এটিই কোনো ব্রিটিশ আইসিএস কর্মকর্তার লেখা কোনো আত্মজীবনীমূলক বই, যা বাংলাদেশ থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। এ বইয়ের একটি জায়গায় স্টিফেন লিখেছেন, ‘আমাকে যদি কোনো দক্ষ তরুণ সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে বলা হয়, তবে আমি সেই কর্মকর্তাদের বেছে নেব বাংলা থেকেই।’ স্টিফেন বেনেডিক্ট হ্যাচ-বার্নওয়েলের লেখা এ বইটিতে রয়েছে এ অঞ্চল সম্পর্কে বহু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য। আর এ বইটির সুবাদে আমরা আরও ভালো করে জানতে পেরেছি বাংলাপ্রেমী এক সাহেবকে।