'মাইনষ্যে ফকির কইয়্যা গালি দেয়'

টুলু
টুলু

‘দুফরে খাইছি আধা পেলেট খিছুড়ি, আধা পেলেট বিরানি, এট্টু কোক, দুইট্যা ফুচকা, একটা পাকোড়া, আধা ভেলপুরি। তারপরে গেছিলাম ফটোকপির ওহানে। সেহানে আধা গেলাস লেবুর শরবত আর আধা পরোটা খাইছি ডাইল দিয়া।’ খাবারের বিবরণ বলতে গিয়ে হয়তো নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গিয়েছিল শিশুটি। কথা থামিয়ে লম্বা শ্বাস নেয় শিশুটি। নাম টুলু। বয়স আট বছর। পেটের তাগিদে এই বয়সেই সে ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমে পড়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে টিএসসি, ছবির হাট, শাহবাগ, রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ওর ভিক্ষা করার জায়গা। ১৭ মে বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কথা হলো ওর সঙ্গে।
জিজ্ঞেস করলাম এত খাবার খাও তুমি?
‘কী যে কন আফা?’ প্রশ্নকর্তার অজ্ঞতায় আবারও মুচকি হাসে টুলু। ‘এইডা তো কিছু না। পইলা বৈশাখ আর ভেলেনটাইনের দিন তো আরও বেশি খাই। চাইয়্যা খাইতে তো আর টেকা লাগে না!’
এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার করে টুলু। দুপুরের একটু আগে টুলু খাবারের দোকানগুলোর সামনে ঘুরঘুর করতে থাকে। তাও আবার দোকানির চোখ এড়িয়ে। তারপর লক্ষ রাখে, কেউ খাচ্ছে কি না! কেউ যদি খেতে শুরু করে, খাবারের শেষ দিকে হাজির হয় টুলু। তারপর হাত পেতে বলে, ‘ভাইয়্যা একটু দ্যান। সারা দিন কিছু খাই নাই।’ কারও কারও ওর জন্য মায়া হলে, খাবারের অবশিষ্ট অংশ দিয়ে দেয়। সেটাই খেয়ে টুলু পেট ভরায়। ‘তয় আফা যেদিন মাংস আর নুডুস খাই, সেদিন খুব মজা লাগে। মন চায় সারা দিন এইগুলা খাই।’
ওকে থামিয়ে এবার প্রশ্ন করি, ‘তোমার বাবা-মা কেউ আছে?
‘আছে আপা। আমরা সবাই সোরার্দী পার্কে থাহি। সেহানেই ঘুমাই। বাবা ফেলাক্সে কইর্যা চা বেচে। বড় ভাই দোকানে দোকানে পানি বেচে।’
সবাই কাজ করে, তাহলে তুমি চেয়ে খাও কেন?
‘মায় কইছে। তাইলে বেশি টেকা খরচ হয় না। আবার আমিও তো টেকা পাই। সেগুলা মারে দিয়া দেই। মায় চাইল-ডাইল কেনে।’
তুমি টাকা পাও কীভাবে?
‘সবার কাছে গিয়া গিয়া সাহাঘ্য চাই। ভিক্ষা করি। ডেলি এক শ-দেড় শ টেকা পাই। খালি খাইলে কি পোষাইব? টেকা দরকার আমগো।’
কখন ভিক্ষা করে জানতে চাইলে টুলু দিনের রোজনামচাটা মেলে ধরে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই পার্কে যায় ভিক্ষা করতে। যারা হাঁটতে আসে তাদের কাছে ভিক্ষা চায়। তারপর ছিন্নমূল শিশুদের জন্য পার্কের ভেতরেই কিছু স্কুল আছে। সেগুলোতে পড়তে যায়। সবগুলো স্কুলে পড়তে যাওয়ার বিষয়ে বললাম, টুলুর বক্তব্য হচ্ছে, সে সবগুলো স্কুলেই পড়তে ভালোবাসে। তাই সবগুলোতে নিয়ম করে যায়। স্কুল শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে যায়। এর মধ্যে টুলু কোনো দিন হয়তো চা আর একটা বনরুটি, আবার কোনো দিন কিছু না খেয়েই চালিয়ে দেয়। তাই দুপুরে খিদেটা লাগে বেশি। দৌড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবার দোকানগুলোয় চলে আসে। খাবার খাওয়া আর ভিক্ষা করা একই সঙ্গে চলতে থাকে। যারা খাবার দেয় না, তাদের কাছে ভিক্ষা চায়। এভাবে রাত পর্যন্ত ভিক্ষা করে টুলু।
নিজেই নিজের রোজগারের কৌশলের গোপন তথ্য ফাঁস করে ছোট্ট টুলু। হেসে বলে, ‘ভাইয়্যা আফাগো সামনে যাইয়্যা কই, দ্যান দুইডা টেকা দেন, ভাত খামু।’
এবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভিক্ষা করতে তোমার ভালো লাগে?’
চুপ করে থাকে টুলু। নখ দিয়ে প্যান্ট খুঁটতে থাকে। বলে, ‘সব সময় ভালা লাগে না। তয় যেদিন বেশি টেকা পাই, সেদিন ভালা লাগে। ভিক্ষা না কইর্যা কী করুম কন? কামাই না করলে চলব ক্যামনে? ’
কত দিন ধরে ভিক্ষা করো তুমি?
‘পাঁচ বচ্ছর ধইর্যা!’ কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করতে আবার বলে, ‘বিশ্বাস করলেন না? তিন বচ্ছর বয়স থেইক্যা আমি ভিক্ষা করি। তহন মায় দূরে বইয়্যা থাকত। আমি ভিক্ষা করতাম। এহন আমি একাই পারি।’
বড় হয়েও কি তুমি ভিক্ষা করতে চাও?
‘না আফা। মাইনষ্যে ফকির কইয়্যা গালি দেয়। তহন আর ভিক্ষা করতে মন চায় না।’
এরই মধ্যে একটু দূরে কয়েকজন শিক্ষার্থী হেঁটে যাচ্ছিলেন। ওদের পেছন পেছন টুলুও দৌড়ে যায়। স্বভাসসুলভ হাতও পাতে। ফিরে আসে হাসিমুখে। ওর হাতে পাঁচ টাকার একটা নোট। সেটা পকেটের আরও টাকার সঙ্গে রেখে দেয়।
তারপর কৈফিয়তের সুরে বলে, ‘আইজ তো বেশি টেকা পাই নাই। তয় আফা সতেরো বচ্ছর বয়স হইলে আর ভিক্ষা করুম না। মায় কইছে তহন আমারে ওয়ার্কশপের কাম শিখাইব।’