ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুরা

আলোকচিত্রী সাহাদাত পারভেজ বেশ কিছুদিন আগে ছবিটি তুলেছিলেন৷ শিশুটি হয়তো এখনও ভিক্ষা করে যাচ্ছে
আলোকচিত্রী সাহাদাত পারভেজ বেশ কিছুদিন আগে ছবিটি তুলেছিলেন৷ শিশুটি হয়তো এখনও ভিক্ষা করে যাচ্ছে

রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ সড়কে জ্যামে আটকে আছে শত শত গাড়ি। ছোট ছোট শিশু উত্তপ্ত রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটছে আর গাড়িগুলোর জানালায় ভিক্ষার জন্য হাত পাতছে। কেউ সাড়া দিচ্ছেন, কেউ দিচ্ছেন না। গরমে ঘেমে যাওয়া শিশুরা বিশ্রামের জন্য ফুটপাতে গাছের ছায়ায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আবার জোর করে ভিক্ষায় পাঠাচ্ছেন এক নারী। কাছে গিয়ে কথা বলতেই মধ্যবয়স্ক নারী নিজেকে শিশুদের মা বলে পরিচয় দিয়ে বললেন, তাঁর নাম ফাতেমা বেগম। আগারগাঁওয়ের একটি বস্তিতে থাকেন। গরমের মধ্যে জোর করে শিশুদের দিয়ে এভাবে ভিক্ষা করানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভিক্ষা না করলে খাইব কী?
আপনি তো কাজ করতে পারেন—এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভিক্ষা দিতে মন না চাইলে দিয়েন না। তাও এত কথা কইয়েন না।’
কমলাপুর রেলস্টেশনে ভিক্ষা করে পাঁচ বছরের শিশু আলম মিয়া। সে জানায়, তার মা-বাবা কেউ নেই। জন্মের পর থেকে এখানেই বড় হয়েছে। দূর সম্পর্কের এক চাচি তাকে নিয়ে ভিক্ষা করতেন। এখন সে আর চাচির সঙ্গে থাকে না। কিন্তু আর ভিক্ষা ছাড়তে পারেনি। ভিক্ষা করে যা উপার্জন করে, তা দিয়েই সে চলে।
রাজধানীসহ সারা দেশে এমন অনেক শিশু আছে, যারা ভিক্ষার সঙ্গে জড়িত। তাদের অনেককেই ভিক্ষা করাতে বাধ্য করা হয়। অনেক সময় অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ শিশুদের ব্যবহার করেও ভিক্ষার ঘটনা ঘটছে। রাজধানীর পথঘাট, বাড়ি, হাসপাতাল এলাকা, ওভারব্রিজ, কবরস্থান, হাইকোর্ট, বিভিন্ন মসজিদ ও মাজার, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, বিমানবন্দরেও অসংখ্য শিশু ভিক্ষুকের দেখা মেলে। বেশ কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র শিশুদের দিয়ে জোর করে বা ভাড়া করে শিশুদের ভিক্ষায় ব্যবহার করছে।
শিশু আইন ২০১৩ অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন বা কোনো শিশুর দ্বারা ভিক্ষা করান অথবা শিশুর হেফাজত, তত্ত্বাবধান বা দেখাশোনায় নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগদানে প্রশ্রয়দান বা প্রদান করেন, তাহলে সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবে। এ অপরাধের জন্য ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা জানান, শিশুদের ভিক্ষা বন্ধে আইন থাকলেও আইনের বাস্তব প্রয়োগ নেই। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে প্রকাশ্য শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহারের ঘটনা ঘটছেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সুস্থ-স্বাভাবিক কাজে সামর্থ্যবান মানুষ কাজ না করে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তির কাজ পরিচালনা করছে। সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২০১১-২০১২ সালে ঢাকায় একটি ভিক্ষুক জরিপ পরিচালনা করা হয়। ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক ওই কর্মসূচির জরিপে ঢাকায় ১০ হাজার ভিক্ষুকের একটি তালিকা করা হয়। ওই জরিপের প্রতিবেদন অনুসারে প্রতিবছর নদীভাঙন, ফসলহানি, দরিদ্র অবস্থায় উপনীত হওয়াসহ নানা কারণে গ্রামের ছিন্নমূল জনগোষ্ঠী কাজের সন্ধানে বা উন্নত জীবনের আশায় শহরমুখী হচ্ছে। কিন্তু আশানুরূপ কাজের সুযোগ না পেয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত হচ্ছে। এদের একটি বড় অংশ হচ্ছে শিশু৷ এ ছাড়া একশ্রেণির অপরাধী চক্র শিশুদের অপহরণ করে তােদর শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী বানিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করছে।
শিশুদের নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করার জন্য একদিকে যেমন শিশুকে বিকলাঙ্গ করে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে, তেমনি সুস্থ শিশুকে ভিক্ষার কাজে ব্যবহার করার কারণে তাকে ধীরে ধীরে পরনির্ভরশীল জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এখান থেকে অনেক শিশু দ্রুতই অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। এসব শিশুই পরবর্তী সময়ে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে। তাদের দিয়ে মাদক বহনের ঘটনাও ঘটছে।
এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরিন বলেন, শিশুরা অনেক কিছুই জানে না বা বোঝে না। মা-বাবা বা অন্যরা শিশুদের ব্যবহার করে সহানুভূতি আদায় করে ভিক্ষা করছে। শিশুরা ছোট থেকে এ ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকার ফলে তারা পরনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। পরে তারা এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। শিশুকাল থেকে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত থাকার কারণে তাদের মানসিক গঠন ঠিকমতো হয় না। তাদের সামাকিজীকরণ ব্যাহত হয়। তাদের দিয়ে কেবল ভিক্ষাবৃত্তিই নয়, অনেক অপরাধমূলক কাজও করিয়ে নেওয়া হয়। এই চক্র থেকে শিশুদের বের করে আনতে হলে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। শিশু ভিক্ষুকদের শিক্ষার আলোয় এনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আইন অনুসারে দোষী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনাও খুব জরুরি।
ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের নিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সার্ভিসেস ফর চিলড্রেন অ্যাট রিস্ক (স্কার) নামের একটি প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে। এই প্রকল্পের পরিচালক ফজলুজ্জোহা বলেন, ‘শুধু ভিক্ষাবৃত্তিতে কত শিশু নিয়োজিত, তার পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। আমরা চাই না শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করা হোক। আমরা আমাদের প্রকল্পের মাধ্যমে সাতটি বিভাগীয় শহরে সাতটি কেন্দ্রের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের নিয়ে কাজ করছি। সেখানে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত, এমন শিশুদের পুনর্বাসনের কিছু ব্যবস্থাও রয়েছে। এটি ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে করা হবে বলে জানান তিনি।’