'নির্যাতনকারীর শাস্তি হলেই নারী নির্যাতনকমবে'

রীতি ইব্রাহীম
রীতি ইব্রাহীম

নারীরা নিজের ঘরেই বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন, এমন চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে। প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে করা এই জরিপে দেখা গেছে, নারীরা সারা জীবনে একবার হলেও স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, এর হার ৮৭.৭ শতাংশ। আর কর্মস্থলে নির্যাতনের হার ১৬.২ শতাংশ। ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ সার্ভে ২০১১) প্রকাশিত হয় গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর। এই জরিপ পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহীমের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। দেশে নারী নির্যাতন ও এর প্রতিকার বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশে বিভিন্ন বিষয়ে জরিপ চালায়। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমবারের মতো ২০১১ সালে ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন নামে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য জরিপ পরিচালনা করে। কোন প্রেক্ষাপটে জরিপটি চালানো হয়েছিল?

রীতি ইব্রাহীম: পৃথিবীর সব দেশেই নারীরা নির্যাতনের শিকার হন। নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র সব দেশে প্রায় একই রকম। কিন্তু সেটার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন, এটা জানতে জাতিসংঘের পরিসংখ্যান বিভাগ (ইউএনএসডি) উদ্যোগ নেয়। সংস্থাটি জাতিসংঘের সব সদস্যরাষ্ট্রকে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র তুলে ধরার জন্য জরিপ চালানোর অনুরোধ করে। যার ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর এই আহ্বানের ভিত্তিতে ইউএনএফপিএর সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জরিপটি পরিচালনা করে। অন্যদিকে, দেশের নারী আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরাও দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এ জন্যই জরিপটি চালানো হয়। এই জরিপে যাতে প্রকৃত তথ্য বের হয় এ ব্যাপারে পরিসংখ্যান ব্যুরো বেশ আন্তরিক ছিল। জরিপটি চালানোর সময় পুরোপুরি সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। জরিপকাজ শুরুর আগে প্রশ্নপত্রটি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, নারী উন্নয়নে অংশগ্রহণকারী অনেক নারীর সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। প্রশ্নগুলোর অনেকগুলোই ছিল সংবেদনশীল। সেই প্রশ্নগুলো ঠিকভাবে করতে না পারলে, নারীরা সঠিক উত্তর দেবে না। তাই সেসব প্রশ্ন কীভাবে করা হবে, এ ব্যাপারে জরিপকর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের বলে দেওয়া হয়েছিল, নারীরা যখন সাক্ষাৎকার দেবে, তখন তার আশপাশে পরিবারের কোনো ব্যক্তি, এমনকি শিশুও উপস্থিত থাকেতে পারবে না। যাতে নারীরা মন খুলে কথা বলতে পারেন। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় দেখা গেছে, নারীরা প্রাণ খুলে মনের কথা বলেছেন। কারণ পদ্ধতি ছিল সঠিক। আর একটা কারণ হচ্ছে, নারীরা তাঁদের নির্যাতনের কথাগুলো বলার মতো মাধ্যম পাচ্ছিলেন না। তাই প্রশ্ন করামাত্রই নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা নারীরা অবলীলায় বর্ণনা করেন। সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে নারীরা স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন।

প্রথম আলো: জরিপটি প্রকাশের পর সরকার থেকে নারী নির্যাতন বন্ধে কি কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?

রীতি ইব্রাহীম: জরিপে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তাতে দেখা গেছে নারীর প্রতি সার্বিকভাবে নির্যাতনের চিত্র আসলেই খুব ভয়াবহ। তবে, নারীর প্রতি নির্যাতন বন্ধে সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে হলে, সেটা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে। তাই এই সম্পর্কে কোনো উদ্যোগ পরবর্তী সময়ে নেওয়া হয়েছে কি না, সেটা মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ই বলতে পারবে।

প্রথম আলো: আবারও জরিপের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই জরিপে দেখা গেছে, নারীরা ঘরেই বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে গেলেও, নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা কমছে না। নারীরা কেন এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারছেন না। বাধা কোথায়?

রীতি ইব্রাহীম: আসলে দেশের সমাজব্যবস্থাই এর মূল কারণ। একটি শিশু তার শৈশবকাল থেকেই দেখে যে নারীকে অসম্মান করা হয়। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নারীদের অসম্মান করেন। নারীরা নিজের পরিবারেই অসম্মানিত হচ্ছেন। সমাজের অন্য কোনো ক্ষেত্রেও নারীর কোনো মর্যাদা নেই। এই শিশু যখন বড় হবে, স্বাভাবিকভাবেই তার মনে শৈশবের চিত্রগুলোই প্রতিফলিত হবে। তখন সেই মানুষটিও নারীকে হেয় করে দেখবে। যেখানে নারীকে সম্মান দেওয়া হয় না, সেখানে তো নারী নির্যাতন হবেই। তাই শিক্ষা কার্যক্রমে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দিতে হবে। তাহলে সেই শিক্ষা শিশুটির জীবনের পাথেয় হবে। অন্যদিকে দেখা যায়, নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন। কিন্তু কোনো নির্যাতনকারীর বিচার হচ্ছে না। আবার নারীরা সহজে আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার আইনের আওতায় বিষয়টি আনতে হবে।

প্রথম আলো: সব ক্ষেত্রে নির্যাতনকারীরা নজিরবিহীন শাস্তি পাচ্ছে না, এই কারণেই কি নারী নির্যাতন আরও বাড়ছে?

রীতি ইব্রাহীম: সেটা তো অবশ্যই। অনেক আগে দেশে নির্যাতনকারীর নজিরবিহীন শাস্তি হতে দেখা গেছে। সেগুলো জনগণের মনে দাগ কেটেছিল। কিন্তু বর্তমানে এত নারী নির্যাতিত হচ্ছেন, কতজন নির্যাতনকারীর শাস্তির খবর আমরা দেখি? তাই নির্যাতনকারীর শাস্তি হলেই নারী নির্যাতনের হার অনেকাংশে কমে আসবে।

প্রথম আলো: নারী নির্যাতন বন্ধে নারীরা কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারেন? অর্থনৈতিকভাবে নারীরা স্বাবলম্বী হলে কি চিত্রটা পাল্টাবে?

রীতি ইব্রাহীম: নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে নির্যাতন কমবে। কারণ নারীর অর্থনৈতিক শক্তি অনেক চিত্র পাল্টে দেয়। তাতে করে নারীরা আরও বেশি সাহসী হবে। লড়াই করার, প্রতিবাদ করার শক্তি পাবে। তাতে করে নারীর নির্যাতনের হার অনেক কমে আসবে। অন্যদিকে, নারীকে শিক্ষিত হতে হবে। যোগ্যতা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। যখন পুরুষ নারীর যোগ্যতাকে অস্বীকার করতে পারবে না, তখন নারী বর্তমান পরিস্থিতি থেকে সহজেই বেরিয়ে আসবে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুচিত্রা সরকার