'মায়ের বয়স ২০ না হওয়া পর্যন্ত সন্তান নয়'

শাহ্লা খাতুন
শাহ্লা খাতুন

আমাদের দেশে কৈশোর মাতৃত্বের হার প্রায় ৩৩ শতাংশ। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচি পরিচালিত হলেও কমছে না কৈশোর মাতৃত্বের হার। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় অধ্যাপক শাহ্লা খাতুন
প্রথম আলো: কৈশোর মাতৃত্বের কুফল কী কী?
শাহ্লা খাতুন: বিশ্বে ১৪ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে গর্ভধারণের কারণে বছরে ৭০ হাজার মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। গর্ভকালীন জটিলতা দেখা দেওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু কিশোরী মায়ের বেলায় এ জটিলতার হার বেড়ে যায়। কিশোরী শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ে ও সন্তান নেওয়ার জন্য একেবারেই প্রস্তুত থাকে না। কিশোরীর পেলভিস (নিতম্বের মধ্যকার অস্থিকাঠামো) ছোট থাকে। রক্তস্বল্পতা, অপুষ্টি এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকার বিষয়গুলো এ সময় প্রভাব ফেলে। প্রসবপূর্ব খিঁচুনি, বাধাগ্রস্ত প্রসব, প্রসবের সময় আঘাতে প্রজনন অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হওয়া, রক্তপাত বেশি হওয়া, সময়ের আগে সন্তানের জন্ম হওয়া, কম জন্ম ওজন নিয়ে সন্তানের জন্ম হওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। মারা না গেলেও ফিস্টুলার মতো বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় সেই কিশোরী কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। স্বামী-সংসারের দেখাশোনা করতে পারে না বলে সেই কিশোরী বউয়ের ওপর চালানো হয় নির্যাতন।
একবার মা হওয়ার পর পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের সুযোগ না পেলে সন্তানসংখ্যা বাড়তেই থাকে। এখানেই শেষ নয়, কম ওজন নিয়ে জন্মানোর ফলে জন্মের প্রথম বছরে শিশু মৃত্যুর হার বাড়ে। সন্তান মারা না গেলেও প্রতিবন্ধী শিশু হওয়ার হার বেড়ে যায়। অসুস্থ, অপুষ্ট মা ও সন্তানের পেছনে চিকিৎসকের খরচসহ বিভিন্ন খরচের পরিমাণ বাড়তেই থাকে।
প্রথম আলো: কৈশোর মাতৃত্বের কুফল এত বেশি, তার পরও দুই দশক ধরে কৈশোর মাতৃত্বের হার ৩৩ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে কেন?
শাহ্লা খাতুন: কোনো অভিভাবকই চান না তাঁর মেয়ে মরে যাক, খারাপ থাকুক। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, বেশি বয়সে বিয়ে হলে আর বাচ্চা হবে না, মেয়ে বুড়ি হয়ে যাচ্ছে, এ ধরনের সামাজিক চাপ, দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে অভিভাবকেরা মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। স্বামীর পরিবারের চাপে বছর না ঘুরতেই সন্তানের মা হচ্ছে সেই কিশোরী। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, অভিভাবকদের কৈশোর মাতৃত্বের কুফলগুলো সেভাবে জানানো হচ্ছে না। অন্যদিকে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দেব না, সামাজিক বিভিন্ন চাপে তা বেশির ভাগ সময়ই মানা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে একটি সামাজিক সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি জরুরি, যারা প্রতিটি পরিবারকে সাপোর্ট দেবে। আর মেয়ে ভালো এবং নিরাপদ থাকবে এটা ভেবে অভিভাবকেরা বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন। কিন্তু আসলেই কতজন ভালো আছে, সে বিষয়টিও জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রথম আলো: সরকার, এনজিওসহ বিভিন্ন সংগঠনের তো কার্যক্রমের অভাব নেই। তাহলে কি এ তথ্যগুলো যথাযথ স্থানে পৌঁছাচ্ছে না?
শাহ্লা খাতুন: এটা ঠিক কথা। সরকার এবং বেসরকারি পর্যায়ে কার্যক্রম, কর্মসূচির অভাব নেই। তবে এ ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব আছে। একই ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে অনেকে। যথাযথ নজরদারির অভাবে সেবাগুলো যথাযথ ব্যক্তিরা পাচ্ছে কি না, তা সেভাবে দেখা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সমন্বয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। নিরাপদ মাতৃত্ব হচ্ছে নারী ঠিক করবেন তিনি কখন মা হবেন, কয়টা সন্তানের জন্ম দেবেন।
প্রথম আলো: কৈশোর মাতৃত্ব প্রতিরোধ এবং এ ধরনের মাতৃত্বকে নিরাপদ করতে কোন দিকটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
শাহ্লা খাতুন: প্রথমত হলো কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যাবে না। কোনো মা ২০ বছর বয়সের আগে যাতে সন্তান না নেয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির সেবা নেওয়াসহ বিভিন্ন সেবা নেওয়া একার পক্ষে সম্ভব নয়।
বাল্যবিবাহ এবং কৈশোর মাতৃত্ব প্রতিরোধে শিক্ষার বিকল্প নেই। বলা হয়ে থাকে, কোনো মেয়ে যদি স্কুলের একটি ক্লাস উত্তীর্ণ হয়, তাহলে হাজারে দুজনের মাতৃমৃত্যুর আশঙ্কা কমে। এ ছাড়া কন্যাসন্তানের প্রতি বাড়তি যত্ন দেওয়া, কন্যাসন্তানকে পণ্য হিসেবে মনে না করে সম্পদ হিসেবে মনে করতে হবে।
আর যদি সেই কিশোরী মা হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকেই পড়ে, তখন সেই মাতৃত্বকে নিরাপদ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও কিশোরীরা মা হচ্ছে। সেখানে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের হার বেশি। তবে সে দেশের কিশোরী মায়েরা মারা যাচ্ছে না, কেননা তারা পরিবার, রাষ্ট্র থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছে বলেই তা সম্ভব হচ্ছে।
প্রথম আলো: পরিস্থিতি পরিবর্তনে আর কোন কোন দিকে নজর দেওয়া জরুরি?
শাহ্লা খাতুন: ছেলেমেয়েদের প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে স্কুল পর্যায়েই জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যৌনশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নারী ও পুরুষের কিছু আলাদা শারীরিক বৈশিষ্ট্য আছে, তা ছেলেমেয়েদের জানাতে হবে। নিজেকে যৌন হয়রানি বা সবকিছু থেকে নিরাপদ রাখার কৌশল শিখিয়ে দিতে হবে। উন্নত দেশে ছেলেমেয়েদের ব্যাগে কনডম দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে তার দরকার নেই। এ ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। জীবনে যৌনতাকে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে ভাবতে শেখাতে হবে। বিবাহিত, অবিবাহিত সবাই যাতে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারে, সে ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
প্রথম আলো: ধর্ষণসহ বিভিন্ন কারণে কিশোরীরা মা হতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক সময়ই অনেকে এ ধরনের মাতৃত্ব চায় না, কিন্তু হাতের নাগালে সে ধরনের ব্যবস্থা নেই বলে কিছু করতে পারছে না।
শাহ্লা খাতুন: যেসব কিশোরী বা মা এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার বা সন্তানটি নিতে চাইছে না, তাদের বেলায় সরকারকে আরও উদার হতে হবে। এমআরসহ (মাসিক নিয়মিতকরণ পদ্ধতি) বিভিন্ন সহজ পদ্ধতি এই কিশোরীরা যাতে নিতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকে হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জীবনের ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে। এতে করেও মাতৃমৃত্যুর হার বাড়ছে।
 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মানসুরা হোসাইন