'দিলাম চাকরিটা ছেড়ে'

দুই মেয়ের সঙ্গে আলপনা সিকদার
দুই মেয়ের সঙ্গে আলপনা সিকদার

‘আমি অফিসে গেলে আকাশলীনা খুব মন খারাপ করত। আমি অফিসে যাওয়ার পর ও আমার পরনের শাড়ি সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। শাড়ির গন্ধ শুঁকত। শাড়ি ধরেই ঘুমিয়ে যেত। ননদ বলেছিল, মেয়েটাকে এত কষ্ট দিয়ে কীভাবে চাকরি করছেন? ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট পেতাম।’ ছলছলে চোখে কথাগুলো বলছিলেন আলপনা সিকদার।
ইউনাইটেড হাসপাতালের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে চাকরি করতেন আলপনা। বেতন ছিল মোটামুটি ভালোই। কেমন করে একজন মা সন্তানের জন্য নিজের স্বপ্নগাড়ির চাকা থামিয়ে দেন, সেই গল্প শুনতে গিয়েছিলাম আলপনার জিগাতলার বাসায়। ২০ জুন বিকেলে তাঁর বাসার বৈঠকখানায় বসে বলছিলেন জীবনের গল্প।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘ননদের ওই কথার পরই আপনি চাকরি ছেড়ে দিলেন?’
‘না, তখনো ছাড়িনি। তখন মেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের। ওকে স্কুলে আনা-নেওয়া করত আমার ননদ। একসময় ননদকেও বাড়ি চলে যেতে হলো। তখন আর কী করব, মেয়েকে দেখাশোনা করবে, এমন কাউকেই তখন পেলাম না। ওর স্কুলের পাশে একটা শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র ছিল। সেখানে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বাচ্চা রাখা যেত। আমার অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সাড়ে সাতটা বেজে যেত। এই দেড় ঘণ্টা মেয়েকে কে রাখবে? তাই দিলাম চাকরিটা ছেড়ে।’
আলপনা বলেন, ‘সেটা ২০০৬ সালের কথা। যেদিন পদত্যাগপত্র দিতে গেলাম, সেদিন বেশ কষ্ট হয়েছিল। আমি যাঁর অধীনে কাজ করতাম পদত্যাগপত্রটা নিয়ে সেই আপার কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ওমা, তোমার চোখে পানি কেন? আমি কেঁদে ফেললাম। তারপর সব কথা বলে চিঠিটা তাঁর হাতে দিলাম। তিনি বললেন, মেয়ের জন্য নিজের সম্ভাবনাটুকু নষ্ট করছ? ঠিক আছে। কী আর বলব! পরের বছর মা দিবসে আপা একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন, যেখানে লেখা ছিল “যে মা সন্তানের জন্য নিজের স্বপ্নটুকু ত্যাগ করেছে, সেই শ্রেষ্ঠ মাকে শ্রদ্ধা।” সেদিন খুব কেঁদেছিলাম।’
কিশোর বয়স থেকেই আলপনার ইচ্ছে ছিল, নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। তাই স্নাতক শ্রেণিতে পড়ার শুরুতেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা শুরু করলেন। স্নাতকোত্তর শেষ করে শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য কিছু করার তাগিদে প্রশিক্ষণ নেন। মনে মনে শিক্ষক হওয়ার সাধটাও উঁকি দিচ্ছিল অনেক দিন ধরে। শুরু করলেন বিজিএমইতে স্কুলশিক্ষকের কাজ। বস্তির শিশুদের পড়াতেন তিনি সেই স্কুলে। তারপর মনে হলো, আরও বড় হতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন বিসিএস পরীক্ষা দেবেন। পড়া শুরু করলেন জোরেশোরে। এরই মধ্যে ১৯৯৯ সালে বিয়ে হলো তুহিন সমদ্দারের সঙ্গে। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রথম সন্তান হলো ২০০০ সালে। আকাশলীনা। ছোট মেয়ে আর সংসার। এই সামলাতে সামলাতেই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি। তখন বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু মেয়েকে দেখবে কে? তাই আর চাকরি করা হলো না।
আলপনা বলেন, ‘শৈশবেই মাকে হারিয়েছি। তাই মা না থাকার যন্ত্রণাটা বুঝেছি। তাই চাইতাম না যে মেয়েও আমাকে ছাড়া থাকুক। অবশ্য মেয়ের যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন আমার ননদ এল আমাকে সাহায্য করতে। তখন ইউনাইটেড হাসপাতালে কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে চাকরি করা শুরু করলাম। ননদের কাছে মেয়েকে রেখেই চলে যেতাম।’
‘হাসপাতালের চাকরিটা ছাড়ার পর সবাই বলল, আমার সম্ভাবনা ছিল, চাকরিটা ছাড়া উচিত হয়নি। আবার যেন কাজ শুরু করি। কিন্তু বাস্তবতা ছিল একেবারেই বিপরীত। হাসপাতালে কোনো দিবাযত্নকেন্দ্র ছিল না। সেটা থাকলে নিশ্চয়ই আর চাকরিটা ছাড়তে হতো না। মনকে বোঝালাম, ভালো চাকুরে হতে না পারি, ভালো মা তো হতে পেরেছি নিশ্চয়ই! আকাশলীনার পর আমার জীবনে এল সুরশ্রী। ২০০৮ সালে।’
এখন আলপনার প্রতিদিন সময় কাটে দুই মেয়েকে স্কুল, কোচিং, গানের ক্লাসে আনা-নেওয়া করে। আর এর ফাঁকে রান্না আর সন্ধ্যায় পড়ানো।
এখন কি আর চাকরি করতে ইচ্ছে করে?
আলপনা বলেন, ‘মনের ভেতরে ইচ্ছেটা যে নেই, তা নয়। তাই বেসরকারি কলেজশিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষাটা দিতে চাইছি। কোনো কলেজে চাকরি পেলে, করব অবশ্যই। তবে সবটাই নির্ভর করবে মেয়েদের দেখাশোনা করার লোক পাওয়ার ওপর।’