'শিশুকে গুণগত সময় দিতে হবে'

যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে একক পরিবার। সেসব পরিবারে শিশুরা ক্রমশ একা হয়ে পড়ছে। বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এই শিশুরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়। এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

হেলাল উদ্দিন আহমেদ
হেলাল উদ্দিন আহমেদ

প্রথম আলো: আমাদের দেশে মূলত দুই ধরনের পরিবার দেখা যায়: একক আর যৌথ। এর মধ্যে শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য কোন ধরনের পরিবার উপযোগী?
হেলাল উদ্দিন আহমেদ: একক বা যৌথ কোনো একটি পরিবার শিশুর জন্য ভালো, এমনটা বলা যাবে না। দুই ধরনের পরিবার থেকেই শিশুরা বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে। যেমন একক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুর স্বাতন্ত্র্যবোধ, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, নিজের কাজ বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয়। অন্যদিকে, যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুটির মধ্যে সামাজিকতাবোধ জন্মাবে, পরার্থপরতা শিখবে, অন্যের প্রতি সমব্যথী হবে। যেহেতু দুই ধরনের পরিবারে থাকলেই শিশুর গুণগত বিকাশ ঘটে, তাই দুই ধরনের পরিবারই শিশুর জন্য ভালো।
প্রথম আলো: যৌথ আর একক পরিবারের শিশুদের চরিত্রগত পার্থক্য কী থাকে?
হেলাল উদ্দিন আহমেদ: যৌথ পরিবারের শিশুরা অন্যের মতামত সহজেই গ্রহণ করতে পারে। অপরের সঙ্গে নিজের আবেগ-অনুভূতি ভাগ করে নিতে পারে। পারস্পরিক সম্পর্ককে মূল্যায়ন করতে শেখে। আবার গণতান্ত্রিক চর্চারও সুযোগ ঘটে যৌথ পরিবারেই। ‘এইটা আমার, এর চেয়ে এইটা আমাদের...’ এই মানসিকতা তৈরি হয় শিশুর মধ্যে। পরবর্তী জীবনে হিতৈষী হওয়ার ক্ষেত্রে যৌথ পরিবার দারুণ ভূমিকা পালন করে।
প্রথম আলো: একক পরিবারগুলোতে দেখা যায়, বাবা-মা দুজনেই কাজ করেন। আর এতে করে শিশুটি আরও বেশি একাকিত্ব বোধ করে। এই অবস্থা কি তার জীবনের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে?
হেলাল উদ্দিন আহমেদ: যে পরিবারের মা-বাবা, দুজনেই বাইরে কাজ করে, সেসব পরিবারের শিশুরা একাকিত্বে ভোগে। মা-বাবাও বাইরে বেশির ভাগ সময় থাকার কারণে শিশুটিকে কম সময় দেন। এতে করে শিশুটির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আবার বেশির ভাগ সময় শিক্ষাগত যোগ্যতা বা গুণগত মান কম—এমন একজন শিশুটির দেখাশোনা করে। এতে করে শিশুটির গুণগত মান কমে যেতে পারে। এর ফলে বিকাশও স্বাভাবিকভাবে হয় না। তবে এ ক্ষেত্রে মা-বাবা যদি সঠিক দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে এটা কোনো বাধাই নয়। শিশুকে যতটুকু সময় দেবেন, সেটার পুরো মনোযোগ শিশুটিকেই দিতে হবে।
প্রথম আলো: একা একা বেড়ে ওঠে যে শিশুরা, তারা কী ধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগে?
হেলাল উদ্দিন আহমেদ: প্রতিনিয়ত একা থাকার ফলে শিশু হতাশায় ভুগতে শুরু করে। অন্যের কাছে মন খুলে কথা বলতে পারে না। খিটখিটে মেজাজের হয়ে থাকে। বিষন্নতা ও হতাশায় ভোগা থেকে অবাধ্য হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, এই শিশুরা নিঃসঙ্গতা কাটাতে গিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত হতে পারে। প্রযুক্তি অথবা খেলাধুলায় মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত হতে পারে। এটাকে আমরা ‘ইন্টারনেট অ্যান্ড গেমিং অ্যাডিকশন ডিসওর্ডার’ বলি। এই শিশুরা পরিণত বয়সে সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। পারিবারিক জীবনে সফল মানুষ হতে পারে না। এরা পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে ভুগতে পারে।
প্রথম আলো: এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
হেলাল উদ্দিন আহমেদ: যে পরিবারে মা-বাবা দুজনেই বাইরে কাজ করেন, তাঁরা সন্তানকে যতটুকু সময় দেবেন, সেটা পুরোপুরি দিতে হবে। গুণগত সময় দিতে হবে। যাতে শিশুর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক বা মিথস্ক্রিয়া ঘটে। যেন শিশুটি বোঝে, তার মা-বাবা পাশেই আছে। অনেক সময় দেখা যায়, ছুটির দিনে মা-বাবা দুজনেই বাড়িতে থাকেন। কিন্তু নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকেন। অন্যদিকে শিশুটি নিজের মতো একা একা সময় কাটায়। এ রকম করা যাবে না। অভিভাবক যদি দিনে এক ঘণ্টা সময়ও শিশুকে দেন, সেটা পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে দিতে হবে। তাহলেই শিশুটির মনোজগতের একাকিত্ব ঘুচবে। সেই সঙ্গে শিশুর সামনে ঝগড়াঝাঁটি করা যাবে না। এটি শিশুর মনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। মনে রাখতে হবে, শিশুর কোনো আচরণই নিজস্ব আচরণ না, সমাজের অন্যদের প্রতিফলিত আচরণ। সমাজ থেকে সে যা শেখে, তাই করে। তাই শিশুর আচরণ পরিবর্তন করতে হলে নিজের আচরণ পরিবর্তন জরুরি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুচিত্রা সরকার