'জ্বর হলে আম্মুর কাছে থাকতে ইচ্ছা করে'

অনম
অনম

‘মাকে ছাড়া কেউ ভালো থাকে? স্কুল থেকে এসেও মাকে দেখতে পাই না। খুব কষ্ট হয়।’ কথাগুলো সাত বছর বয়সী অনমের। সে লক্ষ্মীবাজারের সেন্ট টমাস কিন্ডারগার্টেনের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
অনমের সঙ্গে কথা হয় ১৮ জুন। অনমরা থাকে পুরান ঢাকায়। বাবা ব্যবসায়ী। মা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। দিনের বেশির ভাগ সময় তাঁরা বাইরে থাকেন। বাবা-মা ছাড়া সময় কেমন কাটে, আমার এই প্রশ্নের জবাবে অনম ওপরের কথাগুলো বলে।
অনম আরও বলে, ‘আমার কত্ত বন্ধু স্কুল থেকে ওদের আম্মুর সাথে বাসায় যায়। ওরা ছুটির পরে কত্ত কিছু খায়। কিন্তু আমি কিছু খেতে পাই না।’
অনমের দিন শুরু হয় সকাল সাড়ে ছয়টায়। মা ঘুম থেকে উঠিয়ে, নাশতা খাইয়ে বাবার সঙ্গে পাঠিয়ে দেন স্কুলে। সারা দিনে আর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হয় না অনমের। অনম স্কুলে থাকে সাড়ে সাতটা থেকে ১০টা পর্যন্ত। দিনের বাকি সময় কাটে বাসার কাজের ছেলে আনোয়ার ও দাদির সঙ্গে।
অনম জানায়, মা কখনো অনমকে স্কুল থেকে আনতে গেলে অনেক মজা হয়। সেদিন অনম যা চায়, তার মা তাকে সব দেন। এদিন অনমের কেনার তালিকায় কী থাকে জিজ্ঞেস করলে জানায়, ‘আইসক্রিম আর চকলেট লাগবেই।’ তবে বিএফসির চিকেন ফ্রাইডও ভীষণ পছন্দ।
অনমের এখনো হাত দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস হয়নি। দাদি বা আনোয়ারকে খাওয়ানোর কাজটা করতে হয়। রাতের খাবার অবশ্য মাকেই খাইয়ে দিতে হয়। তবে ঝামেলা বাধে অসুখের সময়। তখন কিছুতেই মাকে ছাড়া খাবে না অনম। মাকে না পেয়ে কান্না করতে করতে একসময় না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। অনম বলে, ‘জ্বর হলে অনেক কষ্ট। তখন আম্মুর কাছে থাকতে ইচ্ছে করে। দাদুমণি আর আনোয়ারকে তখন ভালো লাগে না।’
অসুখের সময় মা অফিসের জন্য তৈরি হতে শুরু করলেই অনমের মন খারাপ হতে থাকে, শেষ পর্যন্ত তা কান্নায় রূপ নেয়। অনম বলে, ‘আম্মু বলেছে, আমি বড় হলে আর চাকরি করবে না। আমার সাথে সারা দিন বাসায় থাকবে। আমি এখন বেশি বেশি খাই। যাতে তাড়াতাড়ি বড় হই।’ তবে বাবার জন্যও সারা দিন অনমের মনটা কেমন আনচান করে। মুখটা মলিন করেই অনম বলে ওঠে, ‘জানো, বাবাও সারা দিনে বাসায় আসে না। তবে রাতে বাবা আমার জন্য মজার মজার খাবার নিয়ে আসে।’
অনম কথা বলছিল তার হাতের ব্যাটটি ঘোরাতে ঘোরাতে। ক্রিকেট তার প্রিয় খেলা আর সাকিব আল হাসান তার প্রিয় ক্রিকেটার। বড় হয়ে তার মতো খেলতে চায়। যেহেতু একা থাকে, তাই মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার নিয়েই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে অনমের।
এগুলোতে অবশ্য বিভিন্ন ধরনের গেমস খেলতেই পছন্দ ওর। আর নিয়ম করে মুঠোফোনে কিছুক্ষণ পরপর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতেই হবে অনমকে। এর ব্যত্যয় ঘটলে কান্নাকাটি করে বাসা মাথায় তোলে দুষ্টু অনম। আনোয়ারের সঙ্গে বাসার মধ্যেই ক্রিকেট খেলা চলে সমানতালে। তবে মাঠে না যেতে পারার আক্ষেপ ঝরে পড়ে অনমের কণ্ঠে। অনম বলে, ‘সুমন, রাহুল, অভীক মাঠে গিয়ে খেলে। ইশ্, আমি যদি পারতাম। আর ভাল্লাগে না ঘরের মধ্যে খেলতে। আমার বাবা পচা, আমাকে মাঠে নিয়ে যায় না।’ তবে টেলিভিশনে কার্টুন দেখতে পছন্দ করে অনম। আর স্পাইডারম্যান তার একজন স্বপ্নের নায়ক।
বাবা-মা অনমকে সময় দিতে না পারায় তাদের প্রতি অনমের অনেক অভিযোগ। তবে দাদিকে অনেক ভালোবাসে অনম। বলে, ‘দাদুমণি খুব ভালো। সব সময় আমার সাথে থাকে। কিন্তু দুপুরে জোর করে ঘুম পাড়ায়। এটা আমার ভালো লাগে না। আমি দুপুরে ঘুমাতে চাই না।’ তবে পড়ানোর কাজটা মূলত মাকেই সামলাতে হয়। গৃহশিক্ষককে একদম পছন্দ করে না অনম। বলে, ‘একটু ভুল হলেই টিচার বকা দেয়। আম্মু কিছু বলে না। আম্মু লক্ষ্মী।’
ঘড়িতে ছয়টা বাজলেই অনম বাসার ছাদে চলে যায়। অপেক্ষা করে মায়ের আসার। দূর থেকে মাকে আসতে দেখলেই এক দৌড়ে গেটে। তারপর মা রিকশা থেকে নামতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের বুকে। সপ্তাহের শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার এটি নিয়মিত ঘটনা।