বন্ধুত্বের হয় না তুলনা

আজীবন এই বন্ধুত্ব ধরে রাখতে চান ওরা ১১ জন। ছবি: সৈকত ভদ্র
আজীবন এই বন্ধুত্ব ধরে রাখতে চান ওরা ১১ জন। ছবি: সৈকত ভদ্র

বন্ধুত্বের শিকড় কোথায়? শাফায়াত আসিফ রুদ্রর উত্তর, ‘বন্ধুত্বের শিকড়ের নাম আসলে স্কুল। সেই শৈশব-কৈশোরে স্কুলে পড়তে পড়তে যাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব, তারাই যে দখল করে থাকে মনের সবটা এলাকা, সে কথা এখন আমাদের চাইতে কে আর বেশি জানে?’
তাই রুদ্র যেমন ইদানীং চাতকের মতো মুখিয়ে থাকে কোনো একটা ছুটির জন্য, তেমনি রুদ্রের বন্ধু সামি রহমান, নিশাত আনজুম চৌধুরী, শাইয়ারা ইসলাম মৌপিয়া, উম্মে মেহনাজ লাবিবা, সুবহা তারিক, মো. নাঈম, আরিফ সাদিক, নাফিস ফুয়াদ ও শাহাদ ইসলাম মুগ্ধও অপেক্ষা করে ছুটির জন্য। ছুটি পেলেই সব বন্ধুকে নিয়ে একত্র হওয়া হবে! জমিয়ে তুবড়ি ছোটানো যাবে আড্ডার। 
তিন বছর আগে অবশ্য এমন অপেক্ষার প্রহর গুনতে হতো না এই বন্ধুদের। তখন তো রুদ্ররা একসঙ্গে একই স্কুলে পড়ত। ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ তাদের সেই বিদ্যাপীঠের নাম। সেখানে কেজি ওয়ান ক্লাসে শুরু হয়েছিল তাদের পথচলা। তারপর পঞ্চম শ্রেণীর পাট চুকিয়ে রুদ্র চলে যায় খুলনায়। সেখানে মিলিটারি কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয় সপ্তম শ্রেণীতে। রুদ্রর ভাই শাফকাত আসিফ রণও পড়ছে ওখানে, দশম শ্রেণীতে। বড় ভাইয়ের সঙ্গী হয় ছোট ভাই। নতুন জায়গা, নতুন স্কুল, নতুন নতুন সহপাঠী। দিন খারাপ কাটে না রুদ্রের। কিন্তু ঢাকায় ছেড়ে আসা, ফেলে আসা বন্ধুদের জন্য মন পোড়ে তার। ঢাকার বন্ধুদেরও মনটা কেমন কেমন করে রুদ্রর জন্য। তাই তো ছুটির অপেক্ষা। ঈদের ছুটি, পুজোর ছুটি, গ্রীষ্মকালীন ছূটি—একটা কোনো ছুটি পেলেই হলো, রুদ্র ছুটে আসে ঢাকায়। আর রুদ্রকে কাছে পেয়ে ঢাকার বন্ধুরাও অসীমে উড়িয়ে দেয় বন্ধুত্বের ঘুড়ি।
তখন কেবলই বন্ধুদের বাসায় ঘুরে ঘুরে গেট টুগেদার। জমিয়ে আড্ডা আর হই-হুল্লোড়ে দিন পার করা। আজ আরিফের বাসা তো কাল নিশাতের বাসা। পরশু সুবহার বাসা তো তার পরদিন নাঈমের বাসা। কখনো বা দল বেঁধে কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া কিংবা ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়া।
‘একবার আমরা নুহাশ পল্লী গিয়েছিলাম। দারুণ মজা হয়েছিল।’ মৌপিয়ার কণ্ঠে স্মৃতির সুর আর চোখে খুশির ঝিলিক। সেই ঝিলিক ছুয়ে যায় লাবিবার কণ্ঠেও, ‘যেবার চট্টগ্রাম বেড়াতে গেলাম সেবারও কম মজা হয়নি।’
এরা এমনই। ঘরে, বাইরে, স্কুলে—সর্বত্র জারি রাখে বন্ধুত্ব। যদিও পড়াশোনার চাপ অনেক, তাতে কী? স্কুলের পড়াশোনার চাপকে স্বীকার করে নিয়ে এই দলের সবচেয়ে স্বল্পভাষী বলে খ্যাত সামি বলছিল, ‘পড়াশোনার চাপ তো থাকেই। তবে সে চাপকে খুব একটা প্রশ্রয় দিই না আমরা। প্রতিদিনকার পড়ার প্রতিদিন শেষ করেই তবে আড্ডা দিই।’
আর আড্ডা মানে শুধুই আড্ডা নয়। এই আড্ডায় থাকে স্বপ্ন দেখা, থাকে ভবিষ্যতের ছক আঁকা। রুদ্র ভালোবাসে বাস্কেটবল আর ফুটবল খেলতে। কিন্তু ভবিষ্যতে বাবার মতো ব্যবসায়ীই হতে চায় সে। নিশাত ছায়ানটে শিখছে গান, কিন্তু বড় হয়ে হতে চায় স্থপতি। আরিফের ইচ্ছা কম্পিউটার প্রকৌশলী হওয়ার। 
সামি ও মুগ্ধর কাছে ক্রিকেট ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব মনে হয়। তারা অবশ্য জানাল, ভবিষ্যতে তারা ক্রিকেটারই হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। আর সুবহা ও মৌপিয়া? ‘লেখাপড়ার মাঝেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে চাই শেষ পর্যন্ত।’ এক গাল হেসে সহজেই নিজের স্বপ্নের কথা বলে এই দুই বন্ধু।
নানা স্বপ্ন, নানা পরিকল্পনা। তাই আশঙ্কা হয়, একেক জনের পথ একেক দিকে বেঁকে যাবে যখন, তখন কী হবে এই বন্ধুত্বের?
‘ভবিষ্যতে আমরা কেউ হয়তো ডাক্তার হব, কেউ প্রকৌশলী হব, কেউ ব্যবসায়ী হব। তাতে কী? ‘বন্ধুত্বের হয় না পদবি। বন্ধুত্ব আজীবনের।’ একসুরে গেয়ে ওঠে এই তরুণ বন্ধুদল।