নরওয়েতে প্রযুক্তির পরশ

গ্রামীণফোন-প্রথম আলো আই–জিনিয়াস গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পুরস্কার হিসেবে নরওয়ে ঘুরে এলেন কক্সবাজার সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সীলমা সুবাহ রাইসা। এ লেখায় থাকছে সে অভিজ্ঞতা।

সীলমা সুবাহ রাইসা: গ্রামীণফোন-প্রথম আলো আই–জিনিয়াস গ্র্যান্ডমাস্টার
সীলমা সুবাহ রাইসা: গ্রামীণফোন-প্রথম আলো আই–জিনিয়াস গ্র্যান্ডমাস্টার

দূর থেকে অপেরার বিশাল ‘ও’ দেখেই বুঝে গেলাম অপেরা বেশি দূরে নয়! অসলো অপেরা অফিসে ঢুকতেই কর্মকর্তারা অভিনন্দন জানালেন আমাদের। অবাক হলাম, সবাই আমাকে চেনে! সীলমা নামটা তাঁদের আগে থেকেই জানা! বিস্ময়ে মুখ হা ছিল কতক্ষণ জানি না। এ যে ইউরোপের এক কুলীন রাষ্ট্র নরওয়ে। এখানেও আমি পরিচিত! এর পেছনের গল্পটা এ রকম: ২০১২ সালের গ্রামীণফোন-প্রথম আলো আই-জিনিয়াস গ্র্যান্ডমাস্টার নির্বাচিত হয়েছিলাম আমি। সেবার ইন্টারনেট উৎসবে সারা দেশ থেকে অংশ নিয়েছিল প্রায় পাঁচ লাখ প্রতিযোগী। কক্সবাজারের মেয়ে আমি। ২০১৩ সালের জুনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় ১২১ জনকে হারিয়ে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম সনদ, একটি স্মার্ট ফোন, এক লাখ টাকা এবং গ্রামীণফোন ও অপেরা মিনির সৌজন্যে নরওয়েতে শিক্ষা সফরের সুযোগ। আমার নরওয়ে ভ্রমণ ছিল সেই শিক্ষাসফরেরই অংশ।
গ্রামীণফোনের কর্মকর্তা সায়মা রহমান ছিলেন আমার সফরসঙ্গী। অসলো পৌঁছেই যে ব্যাপারটা আমাকে মুগ্ধ করল, তা ছিল সবুজের ছড়াছড়ি! যেদিকে চোখ যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ৷ বিমানবন্দরের মতো ব্যস্ত জায়গাতেও মানুষের তেমন ভিড় নেই। কী নির্জন, কী কোলাহলমুক্ত! আগেও জানতাম নরওয়ের জনসংখ্যা কম। তবে এত কম তা ভারতেই পরিনি। টেলিনর আর অপেরা সফটওয়্যার থেকে দুজন কর্মকর্তা আমাদের বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে এলেন। তাঁরা আমাদের পুরো সফরে গাইড হিসেবে ছিলেন। বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই অসলো শহরের বেশ কিছুটা দেখিয়ে ফেললেন। রাজবাড়ি, ন্যাশনাল থিয়েটার, পার্লামেন্ট ভবন আরও কত কি! প্রথম দিনই বুঝলাম যে অসাধারণ সুন্দর আর আধুনিক স্থাপত্য নরওয়ের বহুতল ভবনগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য।

রাইসাকে সনদ দিচ্ছেন অপেরা মিনি কর্মকর্তা
রাইসাকে সনদ দিচ্ছেন অপেরা মিনি কর্মকর্তা

পরের দিনের লক্ষ্য অপেরা সফটওয়্যারের সদর দপ্তর। অর্জুন ভাট পুরো অফিস ঘুরে দেখালেন। বিশ্বসেরা এই সফটওয়্যারের প্রধান কার্যালয় এতই শান্তিপূর্ণ, এতই নির্জন, তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। অপেরা সফটওয়্যার কীভাবে কাজ করে, কেন তা এত দ্রুত, অন্য ব্রাউজার থেকে অপেরা কেন আলাদা—আমাকে সব ব্যাখ্যা করে বোঝানো হলো। ছোটখাটো একটা কোর্স। কোর্স শেষে অপেরা থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া হলো আমাকে।
এরপর লক্ষ্য টেলিনরের সদর দপ্তর। এর বিশালতা আর অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী মুগ্ধ করার মতো। ভবনের অধিকাংশ দেয়াল আর সবচেয়ে ওপরের ছাদ স্বচ্ছ কাচের তৈরি। সূর্যের আলোর প্রতিটি কণা তারা ব্যবহার করছে। নরওয়ে আর টেলিনরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানানোর পর টেলিনর নিয়ে একটা ‘ফোরডি’ প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হলো। প্রযুক্তির সে কী বিশাল আয়োজন! তাঁদের এক পরিসংখ্যানে দেখলাম, টেলিনর মোবাইল নেটওয়ার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যবহারকারীই বাংলাদেশের, অর্থাৎ গ্রামীণফোনের। বাকি ৫০ শতাংশ এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। এ জন্যই হয়তো বাংলাদেশ তাঁদের কাছে খুব পরিচিত নাম।
এবার নরওয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বারগেন দেখার পালা। স্বপ্নের মতো শহর বারগেন। পুরোনো ঐতিহ্য কীভাবে ধরে রাখা যায়, বারগেন তার উদাহরণ। অসলো ফিরে তাদের পর্যটক আকৃষ্ট করা সব জায়গা ঘুরলাম। এভাবেই সাত দিনের (২০–২৭ জুন) নরওয়ে শিক্ষাভ্রমণ শেষ হলো। এরপর নিজ খরচে নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও ইংল্যান্ড ঘুরে দেশে ফিরি ২০ জুলাই।
এক মাসের ইউরোপ ভ্রমণে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলো জুড়ে আছে নরওয়ে। নরওয়ের ভালো লাগা বলে শেষ করার নয়। বিস্মিত হয়েছি নরওয়ের সংবাদপত্রগুলোতে বিজ্ঞাপনের পাশে ‘কিউআর কোড’ দেখে। মোবাইল ফোন দিয়ে স্ক্যান করলেই সেই প্রোডাক্টের সব তথ্য জানা যাবে। ট্রেন, বাস, দোকানপাট—সবখানেই ফ্রি ওয়াইফাই। ইন্টারনেটের এত সহজলভ্যতা আর অত্যন্ত দ্রুতগতি তাদের জীবনযাত্রা আরও সহজ করে দিয়েছে। নরওয়ের নাগরিকদের অ্যাপসের ওপর ব্যাপক নির্ভরতা চোখে পড়ার মতো। মোবাইলে হাত ছোঁয়ালেই ট্যাক্সি চলে আসে, ট্রেনের টিকিট করা যায়, কোন বাস কোন সময় কোন স্টপেজে আসবে, মুহূর্তেই তারা জেনে যায় মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। এমনকি পকেটে ক্রেডিট কার্ড নিয়ে ঘুরতেও তারা এখন যেন রাজি নয়। কারণ, ক্রেডিট কার্ড তো তাদের মোবাইল অ্যাপসে! ছেলে-বুড়ো সবার হাতেই স্মার্টফোন। সবখানেই সেই ফোনের যথাযথ ব্যবহার। আধুনিক আর ডিজিটাল জাতি একেই বলে! বাস স্টপেজে গেলে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে কত সময় পর বাস আসবে, আর চালকবিহীন অতিদ্রুত ট্রেইন তো আছেই! তথ্যপ্রযুক্তি দিয়েই তারা আজ আধুনিক জাতি হিসেবে বিশ্বে সুপরিচিত। বাংলাদেশেও যদি তথ্যপ্রযুক্তির এত চমৎকার ব্যবহার করা যায়, দেশের প্রায় সব মানুষ যদি শিক্ষিত হয়, প্রত্যেক শহরে-গ্রামে যদি তথ্যপ্রযুক্তির আলো ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশও ‘আধুনিক’ ও ‘ডিজিটাল’ দেশ নামে আখ্যায়িত হবে। তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্ম কি পারব না দেশকে সেই সম্মানটুকু এনে দিতে?­