বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ইলেকট্রনিকস

সায়ীফ সালাউদ্দিন
সায়ীফ সালাউদ্দিন

ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করলে ব্যাটারির চার্জ দ্রুত শেষ হয়ে যায়, এ সমস্যা সব ব্যবহারকারীর। এ তো গেল আমাদের চোখের দেখা। আর বাকি সব ইলেকট্রনিক সামগ্রী যেমন: টেলিভিশন, কম্পিউটার, ঘড়ি ইত্যাদির উন্নয়নের সঙ্গে এসবের বিদ্যুৎশক্তির খরচও বেড়েছে, যা অনেক সময় আমরা খেয়াল করি না।
এর ফলে প্রতিনিয়ত বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। খরচেও হাত পড়ছে মানুষের। কার্যক্ষমতা ঠিক রেখে এসব ইলেকট্রনিক সামগ্রীর বিদ্যুৎশক্তির খরচ কমিয়ে এ সমস্যার একটি সমাধান দিয়েছেন বাংলাদেশের গবেষক সায়ীফ সালাউদ্দিন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ প্রকৌশল ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
এ উদ্ভাবনসহ গবেষণায় মৌলিক অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সায়ীফ পেয়েছেন তড়িৎ প্রকৌশলের সর্বোচ্চ সংস্থা আন্তর্জাতিক তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশলী ইনস্টিটিউটের ন্যানোটেকনোলজি আর্লি ক্যারিয়ার পুরস্কার (২০১২)। কার্যকারিতা বজায় রেখে কম শক্তির ইলেকট্রনিক সামগ্রী তৈরির নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে তাঁর এ উদ্ভাবন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তখন এমন ফোন পাওয়া যাবে, যা একবার চার্জ করলে দীর্ঘক্ষণ তা ধরে রাখতে পারবে।
ইলেকট্রনিক সামগ্রীর মূল চালক মাইক্রোপ্রসেসরগুলোর কার্যক্ষমতা যত বেশি বাড়ছে, শক্তি খরচের পরিমাণও তত বেড়ে যাচ্ছে। মাইক্রোপ্রসেসরের কেন্দ্রে রয়েছে ট্রানজিস্টর।
উদ্ভাবনের ব্যাখ্যা দিয়ে সায়ীফ বলেন, ট্রানজিস্টরের মধ্যে একসঙ্গে একই কাজে সম্পৃক্ত ইলেকট্রনগুচ্ছের একটিকে স্থানান্তর করা হলে বাকিগুলোও সেটিকে অনুসরণ করবে বাড়তি শক্তি ছাড়াই। আর এভাবে পাওয়া যাবে কম শক্তির ইলকট্রনিকস। কিন্তু প্রচলিত ইলেকট্রনিক সামগ্রীতে একটি একটি করে ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হয়। ফলে একটি ইলেকট্রনকে পাঠাতে যত শক্তি লাগে, হাজারটা পাঠাতে তার হাজার গুণ শক্তি লাগে। এভাবে বিদ্যুৎশক্তি খরচও বেড়ে যায়।
শুধু তাত্ত্বিকভাবে নয়, ২০১১ সালে বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ পরীক্ষাগারে সায়ীফ সেটা প্রমাণ করে দেখালেন। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘নেগেটিভ ক্যাপাসিটেন্স’।
ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি আর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতকের পর আমেরিকার পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেন সায়ীফ। সে সময়েই ঋণাত্মক ক্যাপাসিটেন্সের গবেষণার জন্য সবার নজরে পড়েন তিনি। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে—২০০৮ সালে এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে শিক্ষকতার আমন্ত্রণ পান সায়ীফ। কিন্তু তিনি তাঁর কাজের ক্ষেত্র হিসেবে বার্কলেকেই বেছে নেন। এখন তাঁর অধীনে কাজ করছেন ১৮ জন গবেষক, যাঁর দুজন বাংলাদেশি। তাঁর তত্ত্বাবধানে এরই মধ্যে চারজন শিক্ষার্থী পিএইচডি, একজন মাস্টার্স এবং চারজন পিএইচডি-উত্তর গবেষণা করেছেন।
প্রিয় শিক্ষার্থী সম্পর্কে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক রেজওয়ান খান বলেন, ‘কাজের প্রতি সায়ীফের একাগ্রতা ও নিষ্ঠা যেমন অনুকরণীয়, তেমনি তার বিনয়ও সমানুকরণীয়। অত্যন্ত মেধাবী এই শিক্ষার্থী আচরণের দিক থেকে একেবারেই মাটির মানুষ।’
সায়ীফের বাবা এ এস সালাউদ্দীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। মা সায়েদা সালাউদ্দিন গৃহিণী। গর্বিত এ মা জানালেন, ছোটবেলা থেকেই সায়ীফ খুব পড়ুয়া ছিল। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে গল্প ও বিজ্ঞানের বইয়ে ছিল তার সমান আগ্রহ।
ইতিমধ্যে সায়ীফের পেশাদারি ঝুলিতে জমা হয়েছে নানা পুরস্কার ও স্বীকৃতি। এর মধ্যে মার্কো-এফসিআরপি ইনভেন্টর রিকগনিশন পুরস্কার (২০০৭), আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ইয়ং ইনভেস্টিগেটর পুরস্কার (২০১০), এফোসর (এএফওএসআর) ইয়ং ইনভেস্টিগেটর পুরস্কার (২০১৩), এআরও ইয়ং ইনভেস্টিগেটর অ্যাওয়ার্ড (২০১৩) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
স্ত্রী তানভীন জামান এবং সাড়ে তিন বছরের ছেলে সাঈফী মাহির সালাউদ্দিনকে নিয়ে সায়ীফের সংসার।
আমিই বাংলাদেশ নিয়ে পরামর্শ ও তথ্য যোগাযোগ: [email protected]