স্বপ্নের গাড়িতে জাপানে

নিজের আঁকা এই ‘পাখি-গাড়ি’ই জাপান থেকে রৌপ্যপদক এনে দিয়েছে ঐশ্বর্যকে
নিজের আঁকা এই ‘পাখি-গাড়ি’ই জাপান থেকে রৌপ্যপদক এনে দিয়েছে ঐশ্বর্যকে

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। মো. শরিফুল ইসলাম খান আর রুবাইদা বিনতে রেজা দম্পতি তখন থাকেন বগুড়ার সোনাতলায়। রাত দেড়টার দিকে তাঁদের দুবছরের মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। কী কারণ? সে ছবি আঁকবে। তার এক্ষুনি রংপেনসিল চাই। চাই-ই চাই! ঘরে রংপেনসিল ছিল না। এদিকে মেয়ের কান্নাও থামে না। মা-বাবা পড়লেন বিপাকে। অবশেষে শরিফুল ইসলাম মাঝরাতেই বাইরে বেরোলেন। দোকানদারকে ঘুম থেকে উঠিয়ে, দোকান খুলিয়ে, রংপেনসিল কিনে এনে তবেই রক্ষা।

জাপানে পুরস্কার প্রদান মঞ্চে ঐশ্বর্য
জাপানে পুরস্কার প্রদান মঞ্চে ঐশ্বর্য

শরিফুল-রুবাইদা দম্পতির সেই দুই বছরের মেয়েটার কথা নাহয় থাক। আসুন, পরিচিত হই নাফিসা নোশিন খানের সঙ্গে। ডাকনাম ঐশ্বর্য। বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সে। টয়োটা আয়োজিত ‘স্বপ্নের গাড়ি’ আঁকার প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে কদিন আগে পুরো পরিবার নিয়ে সে ঘুরে এসেছে জাপান থেকে। তা এই পুরো পরিবার বলতে কে কে ছিল তাঁর সঙ্গে? বাবা মো. শরিফুল ইসলাম, মা রুবাইদা বিনতে রেজা আর ছোট বোন ঐন্দ্রিলা। হ্যাঁ, সেদিনের সেই ছোট্ট জেদি মেয়েটাই আজকের ঐশ্বর্য। এখন অবশ্য সে আর আগের মতো জেদ করে না। একটু বড় হয়ে অনেকটাই শান্ত-চুপচাপ হয়ে গেছে মেয়েটা। এতটাই যে কখনো কখনো এমনটাও শুনতে হয়েছে, ‘এত চুপচাপ হলে চলে? আজকালে একটু চটপটে না হলে পিছিয়ে পড়তে হয়।’ তাই বলে ঐশ্বর্য ভেঙে পড়েনি। ’

নতুন অনেক অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে ছোট্ট মেয়েটার ঝুলিতে
নতুন অনেক অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে ছোট্ট মেয়েটার ঝুলিতে

যেভাবে জাপানে
কেমন হতে পারে ভবিষ্যতের গাড়ি? ছোটদের চোখে সেটাই দেখতে চেষ্টা করছে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টয়োটা। ২০০৪ সাল থেকে তারা শুরু করেছে ‘ড্রিম কার আর্ট কনটেস্ট’। এবারের অষ্টম আয়োজনে ৬০টি দেশের শিশুরা অংশ নিয়েছিল তিনটি বিভাগে। অনূর্ধ্ব ৮, ৮ থেকে ১১ আর ১২ থেকে ১৫—এই তিন বিভাগে প্রথমে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আর্ট স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ছবি আহ্বান করেছিল বাংলাদেশে টয়োটার পরিবেশক নাভানা লিমিটেড। সারা দেশের জমা পড়া ছবিগুলো থেকে বাছাইকৃত ১৫০টি ছবি নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে গত ২১ মার্চ। বিচারক ছিলেন শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য ও শেখ আফজাল। তাঁদের বাছাই করা সেরা নয়টি ছবি অংশ নিয়েছে জাপানের মূল প্রতিযোগিতায়। অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে অবশেষে রৌপ্য পদক জিতে নিয়েছে আমাদের ঐশ্বর্যের আঁকা ‘বার্ডস কার’ বা পাখিগাড়ি। তবে বাংলাদেশ থেকে ঐশ্বর্যই প্রথম নয়, এর আগে ‘ড্রিম কার’ চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কার জিতেছে আরও চারজন—তাসনুভা হায়দার, সাদিয়া মুসতারিন, তাবাসসুম ইসলাম আর ইরাম মাহবুব।

জাপানে পুরস্কার প্রদান মঞ্চে ঐশ্বর্য
জাপানে পুরস্কার প্রদান মঞ্চে ঐশ্বর্য

আশ্চর্য ঐশ্বর্য
জাপানে কী দেখে সবচেয়ে ভালো লেগেছে? পুরস্কার পেয়ে কেমন লাগছে? এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে ঐশ্বর্যকে একটু ভাবতে হলো। শুধু একটা প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া গেল ঝটপট, ‘কী আঁকতে তোমার সবচেয়ে ভালো লাগে?’ ঐশ্বর্যের উত্তর—‘পাখি’। পাখি আঁকতে ভালো লাগে বলেই ঐশ্বর্য এঁকেছে পাখি-গাড়ি। নীল মোমরঙে আঁকা ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে, পাখি-গাড়িতে চড়ে গাছে বসা ছোট্ট পাখিগুলোকে খাবার দিচ্ছে একটা মেয়ে।
‘কখনো ভাবিনি, মেয়ের সঙ্গে এভাবে জাপান ঘুরে আসার সুযোগ হবে’—মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলছিলেন গর্বিত মা। একই রকম সুর বাবা শরিফুল ইসলামের কণ্ঠেও। ছোটবেলার জেদি ঐশ্বর্যের গল্প মনে করে হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘আমরা সব সময় ওর মতামতের ওপরই গুরুত্ব দিই। মেয়ের স্থপতি হওয়ার ইচ্ছা। ও যেভাবে বড় হতে চায়, সেভাবেই হোক।’
গত ২৫ থেকে ২৯ আগস্ট, চার দিনের সফরে দারুণ কেটেছে তাঁদের দিন। ২৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে টোকিওর মেগা ওয়েব মঞ্চে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়েছে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী পড়ুয়া নাফিসা নোশিন খানের হাতে। অনুষ্ঠানের আগে-পরেও অতিথিদের সম্মানে টয়োটা রেখেছিল বিশেষ আয়োজন। রুবাইদা বিনতে রেজা বলছিলেন, ‘দারুণ আপ্যায়ন পেয়েছি। টয়োটার কমেমোরেটিভ মিউজিয়াম অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড টেকনোলজিতে ঘুরে ঘুরে গাড়ির ইতিহাস দেখেছি। কীভাবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে একটা আস্ত গাড়ি তৈরি হয়ে যায়, দেখে অবাক হয়েছি। আমাদের জন্য লিমুজিন থেকে শুরু করে জাপানি রিকশায় চড়ার ব্যবস্থাও ওরা করেছিল।’ এত কিছুর মধ্যে কোথায় বেড়ানোটা সবচেয়ে মনে ধরেছে ঐশ্বর্যের? ছোট্ট মেয়েটার জবাব, ‘স্কাই ট্রি’। জাপানের সবচেয়ে উঁচু এই টাওয়ার ঘুরে দেখার ব্যবস্থাও ছিল টয়োটার আয়োজনে। সম্ভবত, যে মেয়েটা পাখি আঁকতে ভালোবাসে, সে পৃথিবীটা অনেক ওপর থেকেই দেখতে চায়!