আমার মা কোথায়?

হারিয়ে গিয়েছিল ওরা। এরপর আর ফিরে যেতে পারেনি মা-বাবার কাছে। চট্টগ্রামের রৌফাবাদে ছোটমণি নিবাস এখন তাদের ঠিকানা। সেখানে কেমন আছে ওরা? লিখেছেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী

হারিয়ে যাওয়া মুখ: ওরা কী কোনো দিনই জানবে না মা-বাবার স্নেহ কাকে বলে? ছবি: জুয়েল শীল
হারিয়ে যাওয়া মুখ: ওরা কী কোনো দিনই জানবে না মা-বাবার স্নেহ কাকে বলে? ছবি: জুয়েল শীল

সানজিদা জিজ্ঞেস করল, ‘আমার আম্মু কোথায়?’
প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। নিরুত্তর তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে।
আবার প্রশ্ন, ‘জানো না?’
মাথা নেড়ে বললাম, ‘না।’
এবার ফুঁপিয়ে উঠল বছর ছয়েকের মেয়েটি। অঝোরে কাঁদতে শুরু করল সানজিদা। গুটি গুটি পায়ে কখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ফারিয়া (৪)। বড় বোনের দেখাদেখি সে-ও কাঁদছে। বুকের ভেতর হু হু করে উঠল। মা কোথায়, বাবা কোথায়? এই প্রশ্ন তো শুধু এই দুই বোনের নয়, ছোটমণি নিবাসের ৫১টি শিশুর। এ প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?
২৫ আগস্ট গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম শহরের রৌফাবাদে ছোটমণি নিবাসে। এটি সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের একটি প্রতিষ্ঠান। হারিয়ে যাওয়া, কুড়িয়ে পাওয়া শিশুদের আশ্রয় মেলে এখানে। কারাগারে বন্দী মায়ের শিশুরাও পায় আশ্রয়, মায়ের কারাভোগ যেদিন শেষ হবে, সেদিন আবার মায়ের কোল ফিরে পাবে তারা। তাদের তো তবু এটুকু সান্ত্বনা আছে, বাকিদের তো তা-ও নেই, তারা হয়তো কোনো দিনই জানবে না মা-বাবার স্নেহ-ভালোবাসা কাকে বলে।

.
.

মিলেমিশে থাকা
তখন সবে বিকেল নেমেছে। ঘর থেকে মাঠে ছুটে এসেছে একঝাঁক শিশু। এক থেকে নয় বছর বয়সী৷ মাঠে নেমেই কেউ দখল নিয়েছে দোলনার, কেউ বা স্লাইডে চেপে নেমে আসছে সরসর করে। এই উচ্ছ্বসিত শিশুগুলোকে দেখে কে বলবে মা-বাবাহীন তাদের জীবনে আছে অপার বঞ্চনা। হয়তো তাদের অনেকে নিজেও জানে না সেই অপ্রাপ্তির কথা। কারণ, অনেকেই জন্মাবধি এখানে বেড়ে উঠছে। বন্দনা সরকার, মিনু আকতারদের কোলে-পিঠে বড় হয়ে হয়তো তাঁদেরই মনে মনে মা ভেবে নিয়েছে৷ একই ঘরে পাশাপাশি শুয়ে-বসে যাদের সঙ্গে বড় হচ্ছে, যাদের সঙ্গে পড়তে বসছে, খেলতে যাচ্ছে মাঠে—তারা সবাই ভাইবোন, একটি বড় পরিবার।
মিনু আকতার বললেন, ‘তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয় বটে, কিন্তু কেউ একজন ব্যথা পেলে, একটু অসুস্থ হলে অন্যরা করুণ মুখে পাশে এসে দাঁড়ায়, কে বলবে তারা আপন ভাইবোন নয়? সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সবাইকে কিছু একটা দেওয়া হলে, এমনকি একটি লজেন্সও, একজন যদি না পায়, বাকিরা সবাই আমাদের কাছে বলতে আসে, “ও পায়নি।” এতটাই টান তাদের পরস্পরের জন্য!’
হয়তো একই দুঃখ-কষ্ট, একই বঞ্চনার বোধ এই শিশুগুলোকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে।
চার মাস আগে ছোটমণি নিবাসে এসেছে রাকিব। বয়স তিন বছর। বাবার নাম শাহজাহান, মায়ের নাম রাহেলা, বাড়ি কুমিল্লা। এটুকুই শুধু বলতে পারে, আর কিছু না। এই সামান্য পরিচয়ের সূত্রে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে রাকিবের মা-বাবাকে? গত ১১ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বটতলী রেলওয়ে স্টেশনে রাকিবকে খুঁজে পেয়েছিলেন মনা নামের এক ব্যক্তি। এরপর পুলিশকে খবর দিলে পুলিশই এখানে পাঠায় রাকিবকে। ছোটমণি নিবাসের তত্ত্বাবধায়ক হাসান মাসুদ বললেন, ‘এখানকার ৫১টি শিশুর মধ্যে ১৯টিই হারিয়ে যাওয়া শিশু। আমরা তাদের পরিবারের লোকজনকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তারা তো ঠিকানা বলতে পারে না।’
চার বছরের মিনহাজ আর পাঁচ বছরের শাহিদা আকতার পিংকি ভাইবোন। সাত মাস আগে পটিয়া সার্কেলের কালারপুল খালের পারে পুলিশ খুঁজে পায় তাদের।
একই ঘটনা আঁখি নুর ও হারুনর রশিদ নামের দুই ভাইবোনেরও। ২০০৯ সালের খুলশি থানার পুলিশ খুঁজে পেয়েছিল তাদের। পাঁচ বছরেও বাড়ি ফিরতে পারেনি তারা।
বাবার নাম মহিউদ্দিন আর মায়ের নাম রোজিনা বলে জানাল সাকিবুল হাসান (৭)। গত বছরের ৫ এপ্রিল বাকলিয়ার কালামিয়া বাজারে একা দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখে তাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যান রাসু আকতার নামের এক নারী। সাকিব জানায়, মা তাকে বাজারের এক পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে হারিয়ে গেছেন।
গত বছর কোনো একটি মাছবাজারে এসে বাবার হাত থেকে ছুটে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল আয়েশা (৭)। বাবার নাম মাহমুদুল হাসান, সংসারে দুই মা ছিলেন, তাঁদের নাম পারভীন ও নার্গিস, বাড়ি বারৈয়ারহাট—এ পর্যন্ত বলতে পারে আয়েশা। কিন্তু তাতেও সন্ধান মেলে না মা-বাবার। বাড়ির পাশে রেললাইন ছিল—এ কথাও মনে করতে পারে সে৷ এখনো ট্রেনের শব্দ শুনলে বাড়ির কথা ভেবে কাঁদতে থাকে সে।
রীতা, প্রান্ত, নুরজাহান, আবু তৈয়ব, আহসান, রিয়া, ইভা, রিফাত, রাবেয়া, মিতুদের গল্পও প্রায় একই রকম। তারা হারিয়ে যাওয়া শিশু। তারা তো তবু মা-বাবার নাম বলতে পারে, এমনকি কেউ বলতে পারে বাড়ির এলাকাটির নামও। তাই ক্ষীণ হলেও থাকছে মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু নিশিতা বা জুঁইয়ের গল্পটা তো আরও করুণ। দুই-তিন দিন বয়সের এই শিশুদের পাওয়া গেছে পথে। তাদের নামও দিয়েছেন ছোটমণি নিবাসের তত্ত্বাবধায়কেরা। এই দুটি শিশু পাঁচ বছর ধরে আছে এখানে। মা-বাবা নামের মানুষগুলো কেমন, তারা জানবে না কখনোই।

‘পৃথিবীতে কে কাহার!’
বছর দুয়েক আগে নীপা আক্তার (৭) নামের একটি শিশুর আশ্রয় হয়েছিল ছোটমণি নিবাসে। এক-আধটু পড়তে-লিখতে পারে বলে তাকে পাঠানো হয়েছিল সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান শিশু পরিবারে। তাকে তারা ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল হামজারবাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সে একদিন স্কুল ছুটির পর হাঁটতে হাঁটতে নিজের বাড়ি চিনে নিয়েছে, পৌঁছে গেছে ষোলশহর কামাল কলোনিতে। শিশুটি স্কুল শেষে ফিরে না আসায় দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন শিশু পরিবারের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা। শেষ পর্যন্ত এমন একটি সুখবর পেয়ে তাঁরা আনন্দিত।
একা (৬) নামের শিশুটি ঠিকমতো বলতে পেরেছিল মা-বাবার নাম আর বাড়ির ঠিকানা। খবর পেয়ে ভৈরব থেকে মা-বাবা বললেন, ‘আমরা আসছি ওকে নিতে।’
রিদোয়ান (৯) পড়ত নাজিরহাট দারুসসুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসায়। ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে চুরি করে নিয়ে এসেছিল এক লোক। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে পাঠিয়েছিল ছোটমণি নিবাসে। সে মা-বাবার নাম, বাড়ির ঠিকানা—সবই বলতে পারে। এখন সমস্যা হয়েছে অন্য রকম। রিদোয়ানের পিতৃত্বের দাবিদার দুজন। নাজিরহাটের দিনমজুর নুর মোহাম্মদকে নিজের বাবা বলে চিনতেও পেরেছে রিদোয়ান। কিন্তু ফটিকছড়ির আবু জাফর ড্রাইভার জানান, ছেলেটিকে ভুল বোঝানো হয়েছে, ছেলেটির নাম আসলে তোহা, সে তাঁরই ছেলে। এই নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ডিএনএ পরীক্ষার পর জানা যাবে, প্রকৃত বাবা কে।
মমতা ও মারুফ নামের সদ্যোজাত দুই শিশুকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় উদ্ধার করে পুলিশ। এর দুই মাস পর উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে মারুফকে নিয়ে যান তার বাবা-মা। কিন্তু মমতার সেই ভাগ্য হয়নি। আজ অবধি তাই তার ঠিকানা ছোটমণি নিবাস।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ছোটমণি নিবাসে কাটিয়ে যখন ফিরে আসছিলাম, তখন হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছিল তারা সবাই। ‘আবার আসবেন,’ বলছিল কেউ কেউ। ছোট্ট একটি মেয়ে খুব কাছে এসে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘চকলেট নিয়ে এসো।’ কী মায়াভরা মুখ, কী আবদারের সুর! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, অশ্রুসজল হয়ে আসে চোখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পের সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তিটি মনে পড়ল, ‘পৃথিবীতে কে কাহার!’

ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার

ঘরে ফেরার অপেক্ষায়
ঘরে ফেরার অপেক্ষায়

সেবার আশ্রয়…
তৌহিদা শিরোপা
বড় বড় পা ফেলে হাতি যাচ্ছে। বাড়ির জানালা থেকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল আলিফ। বয়স পাঁচ কি ছয়। মনে একটা ইচ্ছে উঁকি দিল—মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাতি দেখতে গেলে কেমন হয়। ঘরের মধ্যে উঁকি দিল আলিফ। দেখল মা রান্না করছেন। সেই সুযোগে পা টিপে টিপে দরজা খুলে চলে গেল রাস্তায়। দেখা পেল সেই হাতির। হাতির পিছে পিছে কখন যে চেনা রাস্তা থেকে অচেনা রাস্তায় চলে এল আলিফ বুঝতেই পারল না। যখন টের পেল তখন সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। পথচারীরা তাঁকে দিয়ে এল ঢাকার রমনা থানায়। সেখান থেকে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। এরই মধ্যে আলিফের ছবি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ফেসবুক পেইজে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সাত দিন পরে ঢাকার লালবাগ থেকে আলিফের বাবা এসে তাঁকে নিয়ে যান।
আলিফ মা-বাবার কাছে ফিরে গেছে। সবাই কিন্তু তার মতো ভাগ্যবান নয়। গত ২৬ আগস্ট বাংলাদেশ উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার গিয়ে দেখা গেল আরও চার শিশু এখন মা-বাবার অপেক্ষায় আছে। এখনো খোঁজ মেলেনি তাদের মা-বাবার।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার শুধু হারিয়ে যাওয়া শিশুদের জন্য এই কাজ করে তা নয়। অসহায়, নির্যাতিত নারীদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়। বর্তমানে চারজন হারিয়ে যাওয়া শিশুসহ আরও তিনজন নারী আছেন এখানে। বাংলাদেশ পুলিশ ২০০৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও থানার কাছে চালু করে এই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। তবে ২০১১ সালে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার তার কাজের ক্ষেত্র বাড়িয়ে দেয়। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, নারী নির্যাতনের বিভিন্ন মামলা তদন্ত ও কুইক রেসপন্স টিম গঠন করে নতুন নামকরণ করা হয়, যা এখন উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন নামে পরিচিত। কথা হয় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার ও তদন্ত বিভাগের দায়িত্বরত সহকারী পুলিশ কমিশনার লুবনা মোস্তফার সঙ্গে। তিনি বলেন, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ১৩১ জন শিশুকে তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো শিশু পাওয়া গেলে প্রথমে থানায় জিডি করে এখানে পাঠিয়ে দেয়। মা-বাবার পরিচয় পাওয়া না গেলে বা কেউ নিতে না এলে আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১০টি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) ওদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে পাঁচ থেকে সাত দিন থাকার সুযোগ থাকলেও পরিস্থিতির প্রয়োজনে সময় বাড়ানো হয়। তা না হলে কোর্টের মাধ্যমে সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ওদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়।’
এখানে চারজন কনস্টেবল সার্বক্ষণিক ভিকটিমদের দেখভাল করেন। এ ছাড়া চিকিৎসক, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য পরামর্শক আছেন। প্রতিবন্ধী শিশু ও নারীদের ইঙ্গিত বোঝার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও আছে। অসহায়, নির্যাতিত হয়ে কেউ যদি একবার এখানে আসেন তাহলে তাঁর নিরাপত্তা ও আইনি ব্যবস্থার ভার এই সেবাকেন্দ্রের। ২৪ ঘণ্টা সেবার দরজা খোলা আছে তাদের। ফোন: ৯১১০৮৮৫