সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

যুক্তরাষ্ট্রের ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় ব্যস্ত আশফিয়া হক l ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় ব্যস্ত আশফিয়া হক l ছবি: সংগৃহীত

পেনসিলে ব্যবহৃত নরম গ্রাফাইট এবং পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বস্তু হীরা—দুটিই কার্বন দিয়ে গঠিত। কিন্তু ভেতরের গঠনের ভিন্নতার কারণে একটি শক্ত, অন্যটি নরম। এতেই পাল্টে যায় বস্তুর ধর্ম। তাই নতুন নতুন যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য বস্তুর ভেতরের কাঠামোটা বোঝা জরুরি। 
সে কাজটি বিজ্ঞানীরা নিয়মিতই করেন। তবে বাংলাদেশের আশফিয়া হকের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণা নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে এমন ব্যাটারি আমরা পাব, যা এখনকার তুলনায় অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। কেবল তা-ই নয়, তৈরি হতে পারে হাইড্রোজেন ব্যাটারি।
আশফিয়া কাজ করেন আমেরিকার ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পারমাণবিক বোমার গবেষণার অনেকখানিই হয়েছে সেখানে। বর্তমানে বস্তুর ভেতরের কাঠামো আরও ভালোভাবে জানার কাজ চলছে এখানে। এ জন্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পরমাণুর কেন্দ্রের কণা নিউট্রন। ১৫টি যন্ত্রের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নিউট্রন উৎস; যা স্পেলেশন নিউট্রন সোর্স (এসএনএস) নামে পরিচিত। এটি বানাতে খরচ হয়েছে এক হাজার ৪০০ কোটি ডলার।
এটির নির্মাণকাজের সময় আশফিয়া কাজ করতেন যুক্তরাষ্ট্রের আরগন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির নিউট্রন উৎস ইনটেন্স পালস নিউট্রন সোর্সে (আইপিএনএস)। ২০০৬ সালে তিনি যোগ দেন ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে। তিন বছরের মধ্যে চালু করলেন পাউডার অপবর্তন যন্ত্রটি। এখন এটি ওক রিজের এসএনএসের সবচেয়ে উৎপাদনশীল যন্ত্র। সেখানে মোট ১৫টি বিভিন্ন যন্ত্রের মধ্যে চারটিই তাঁর অধীনে। নির্বাচিত হয়েছেন আমেরিকার উইম্যান ইন এনার্জি কর্মকাণ্ডের অন্যতম বিজ্ঞানী।
এই যন্ত্র-উপকরণগুলো এতই দামি যে কোনো একটি দেশের একার পক্ষে এগুলোর নির্মাণ ও পরিচালনার খরচ বহন করা কঠিন, জানালেন আশফিয়া। তাই বিশ্বের প্রায় সব দেশের বিজ্ঞানীরাই এগুলো ব্যবহার করার সুযোগ পান, যদি তাঁদের গবেষণার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
আশফিয়া নিজের কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, নতুন নতুন উপাদান তৈরি করার জন্য বস্তুর আণবিক কাঠামো বোঝাটা জরুরি। আর এটা বোঝার একটা পদ্ধতি হলো পরমাণু কেন্দ্রের মৌল কণা নিউট্রনের ব্যবহার। বস্তুর ভেতরের কাঠামোটা বোঝার জন্য বাইরে থেকে এই নিউট্রনকে বস্তুর দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। বস্তুকণাকে অতিক্রম করে যাওয়ার সময় ভেতরের কাঠামো নিউট্রনগুলোকে নানাভাবে বিচ্ছুরিত করে। এই প্রপঞ্চকে বিজ্ঞানীরা বলেন অপবর্তন বা ডিফ্র্যাকশন। এই অপবর্তনের নানান বৈশিষ্ট্য থেকেই জানা যায় বস্তুর ভেতরের গঠন। আর পাউডার অপবর্তনে এ ছাড়া ব্যবহার করা হয় খুবই ক্ষুদ্রকায় (এক মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ আকারের) পাউডার। বিভিন্ন বস্তুর আণবিক পর্যায়ের গঠন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাউডার অপবর্তন যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
প্রথম জীবনে শিক্ষক, পরে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফুল হক ও গৃহিণী মাহফুজা হকের দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট আশফিয়া। বড় বোন মাহবুবা হক স্থপতি এবং ভাই মাহমুদুল হক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। গর্বিত বাবা জানালেন, আশফিয়া ছোটবেলায় বিজ্ঞানীদের জীবনীগ্রন্থ পড়তে বেশি ভালোবাসতেন। বিজ্ঞানী মেরি কুরি ও তাঁর কন্যা জুলিও কুরির জীবনী পড়ে আশফিয়া পদার্থবিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ থেকে সম্মিলিত মেধাতালিকায় স্থান করে আশফিয়ার এসএসসি ও এইচএসসি উত্তরণ। ১৯৯২ সালে বৃত্তি নিয়ে পড়তে চলে যান আমেরিকার মাউন্ট হলিয়োক কলেজে। সেখান থেকে পদার্থবিজ্ঞান ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক হন। অর্জন করেন সফল স্নাতকদের দল ম্যাগনা কাম লাউডি গ্র্যাজুয়েট সম্মান। এরপর বিজ্ঞানী পিটার স্টিফেন্সের তত্ত্বাবধানে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন।
আমাদের দেশে সাভারের পরমাণু শক্তি কমিশনেও খুবই ছোট আকারের একটি অপবর্তন যন্ত্র রয়েছে। সেখানকার বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার আগ্রহও প্রকাশ করেছেন আশফিয়া হক। তবে, এখনো কারও সাড়া পাননি বলে জানান। অবসর সময়ে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে আর শুনে সময় কাটে আশফিয়ার।
আমিই বাংলাদেশ নিয়ে পরামর্শ ও তথ্য যোগাযোগ: [email protected]