বিয়ের ছবির জাদুকর

অ্যালেন খানের তোলা একটি ছবি
অ্যালেন খানের তোলা একটি ছবি
অ্যালেন খান
অ্যালেন খান

শুধু তাঁর হাতে ছবি তোলার জন্য কেউ কেউ বিয়ে পিছিয়ে দেন বছর দুয়েক কিংবা আরও বেশি। তাঁর জাদুমাখা হাতের ক্যামেরায় তোলা ছবি ছাড়া বিয়েতে যেন পূর্ণতা আসে না—এমন মনোভাব পোষণ করেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনির উচ্চবিত্ত তরুণ-তরুণীরা। শুধু সিডনি কেন, মেলবোর্ন-ব্রিসবেন-পার্থ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে তাঁর খ্যাতি। ‘ওই তো সেদিন লেবাননের বৈরুতে এক রাজকীয় বিয়ের ছবি তুলে এলাম, কদিন পরে যাচ্ছি নিউইয়র্কে’—এই হচ্ছে তাঁর ব্যস্ততা। তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অ্যালেন খান, অস্ট্রেলিয়ার প্রথিতযশা ‘ওয়েডিং ফটোগ্রাফার’। মানে বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবি তোলেন। স্থির ও চলমান দুই ধরনের ছবিই তোলেন।
সারা দুনিয়ায় বিয়ের ছবি তোলার ব্যাপারটাকে যাঁরা আলাদা মাত্রায় নিয়ে গেছেন, তাঁদের একজন অ্যালেন খান। সিডনিতে তিনি চালু করেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান ‘অ্যালেন খান ওয়েডিং ফটোগ্রাফি অ্যান্ড ভিডিও’। অস্ট্রেলীয় টেলিভিশন ‘এসবিএস’ এক বছর সময় নিয়ে তাঁর বর্ণাঢ্য কাজ ও জীবন নিয়ে তৈরি করেছে ব্রাইডস অব খান তথ্যচিত্র। অস্ট্রেলিয়ান ব্রাইডাল ইন্ডাস্ট্রি একাডেমি ২০০৬ সালে তাঁকে নির্বাচিত করেছে সেরা ফটোগ্রাফার।
আলোকচিত্রী হিসেবে পেশাজীবন গড়ে উঠবে বা খ্যাতিমান হয়ে যাবেন, এমনটা আগে ভাবেননি তিনি। ঢাকায় বেড়ে ওঠা অ্যালেন খান রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ১৯৭৩ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন ঢাকা ফ্লাইং ক্লাবে শিখেছিলেন বিমান চালনা। কোর্সও সম্পন্ন করেছিলেন। সিডনির মার্সফিল্ডে নিজের স্টুডিওতে বসে বললেন, ‘আমি বাংলাদেশে পাইলট ছিলাম। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমাকে রেখে অন্যদের নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ বিমান। তাই কিছুটা অভিমান নিয়েই চলে আসি অস্ট্রেলিয়া।’
কাগজে-কলমে তাঁর নাম হেদায়েতুল্লাহ খান। ফ্লাইং ক্লাবে তাঁর এক বিদেশি প্রশিক্ষক তাঁকে অ্যালেন নামে ডাকতেন। সেই থেকে তিনি অ্যালেন খান নামেই পরিচিত সবার কাছে।
১৯৭৭ সালে প্রবাসে আসার পর সাধারণত যা হয় অন্যদের বেলায়, অ্যালেন খানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বলতে থাকেন, ‘প্রথম দিকে অনেক কষ্ট করেছি। তবে যেকোনো কাজকেই গুরুত্ব দিতাম। তাই কারখানায় সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজে লেগে পড়লাম। পাইলট ছিলাম বলে এখানেও এ কাজটা করতে পারি কি না দেখছিলাম। কিন্তু না, অনুমতিপত্র (লাইসেন্স) পেতে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা ছিল। তাই ওদিকে আর যাওয়া হয়নি।’ এখন অবশ্য দুঃখটা নেই আর অ্যালেন খানের। বললেন, ছবি তোলার কাজটা অনেক আনন্দের।
অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসজীবনে যখন ছবি তোলা শুরু করেন অ্যালেন খান, তখন এ ব্যাপারে তেমন কিছুই জানতেন না। বললেন, ‘গাজী উজ্জ্বল হক অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন আমাদের আগে। পেশাদার আলোকচিত্রী ছিলেন। একদিন আমাকে ছবি তুলতে নিয়ে যান। সেই শুরু। ৩৪ বছর ধরে হাঁটছি এ পথে আর শিখছি ফটোগ্রাফির ভেতর-বাইরের অনেক কিছু।’ ফটোগ্রাফিতে অ্যালেন খানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। বললেন, ‘কাজটা করি হৃদয় থেকে একাগ্রচিত্তে।’ অ্যালেন খানের প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকজন আলোকচিত্রী এখন কাজ করেন।
কাজের মান কীভাবে ধরে রাখতে হয়, সে ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘একদিন সিডনির বিখ্যাত এক গাড়ি বিক্রেতার ব্যক্তিগত সহকারী এলেন। গাড়ি বিক্রেতার মেয়ের বিয়ের ছবি তোলাবেন। সীমিত সময়ের মধ্যে কাজ করতে হবে। টাকাপয়সা মোটামুটি যা চাই তা-ই দেবে। কিন্তু আমি দেখছিলাম, ওই সময়ের মধ্যে মোটেও ভালো কাজ করা যাবে না। তাই তাঁদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম।’ রাতে স্বয়ং গাড়ি বিক্রেতা ফোন করে জানতে চান, কেন অ্যালেন খান কাজটা করবেন না। অ্যালেন খান তাঁকে বলেছিলেন, ‘যদি কেউ টাকা নিয়ে রাতদুপুরে গাড়ি কিনতে চায়, তুমি নিশ্চয়ই দোকান খুলে বসবে না। আমিও আমার কাজটা আমার মতো করতে চাই।’ গাড়ি বিক্রেতা আমার কথা বুঝেছিলেন এবং অনেক সময় নিয়েই অনুষ্ঠানটা করতে বললেন।
১৯৫২ সালে অ্যালেন খানের জন্ম বাংলাদেশের এক বিখ্যাত পরিবারে। বাবা ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার আব্দুল জব্বার খান আর মা ফিরোজা বেগম। অ্যালেন খানের স্ত্রী সাফিনা হেদায়েত। এ দম্পতির এক ছেলে সাদ খান ও তিন মেয়ে সাবরীনা খান, সামরীন খান ও ইসমা খান।
বাংলাদেশি এই আলোকচিত্রীর তোলা বিয়ের ছবিগুলো হয়ে ওঠে জীবন্ত আর চলমান ছবিগুলো যেন গল্পগাথার একেকটি চলচ্চিত্র। সেই ছবি ও চলচ্চিত্রের মোহময় আবহে নব দম্পতির শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলো বেঁচে থাকে যুগ যুগ ধরে। আর তা করতে করতে অ্যালেন খান হয়ে উঠেছেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা ‘ওয়েডিং ফটোগ্রাফার’।