বনভোজনে অন্যরকম অভিজ্ঞতা

আল বাদাইয়া মসজিদ
আল বাদাইয়া মসজিদ

আমিরাতের দুবাইপ্রবাসী আমরা কয়েকজন বাংলাদেশি ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে বেরিয়ে পড়েছিলাম সত্যিকার বনভোজনে। গিয়েছিলাম প্রত্নতাত্ত্বিক নগরী ফুজিরায়। পরবাসী আমাদের দলে ছিলেন রফিক ভাই, লোকমান ভাই, কাওছার ভাই, কয়েছ (সাদিক) ভাই ও আমি।

মাসাফির আঁকাবাঁকা রাস্তা অতিক্রম করে পাহাড়ের বুক চিরে চলছে আমাদের গাড়ি। আরব আমিরাতের সবচেয়ে বড় পানীয় কোম্পানী মাসাফির নামেই এলাকার নাম। রাস্তায় মৃৎ শিল্পের পশরা সাজানো কয়েকটি ছাউনি দোকান আর পর্যটকেদের ​ভিড় দেখে থামালাম গাড়ি। রফিক ভাই ফুটবল কিনলেন সাগরে খেলার জন্যে। আমি ছুটে গেলাম খোলা বাজারে। 

আল বাদাইয়া মসজিদ। রাতে তোলা ছবি
আল বাদাইয়া মসজিদ। রাতে তোলা ছবি



দোকানের বেশিরভাগ কর্মী বাঙালি আর পাকিস্তানি। মৃৎ শিল্পের পাশাপাশি কাপড় ও সুন্দর ফুলও রয়েছে। স্থানীয়রা এসব জিনিসের কাঙাল।দুবাই থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমরা ফুজিরা বিমানবন্দরের কাছে বনের ধারে থামলাম। পেট মহাশয়কে শান্ত করতেই আমাদের থামা। খাওয়া শেষ করে আমাদের পর্যটনের সরঞ্জাম গাড়ির ভ্যানে রেখে ছুটে গেলাম সাগর তীরে। কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে রওনা হলাম কালবার পথে।

কিছুক্ষণ পর আমাদের গাড়ি ঢুকল কালবা শহরে। সাগরের পাশে মাছ ধরার দৃশ্য দেখে মনে হলো এ যেন বাংলাদেশের চির চেনা কোনো চর। আমরা হৈ হুল্লুড় করে সাগরে নামলাম। মৃদু বাতাস আর ছন্দময় ঢেউ প্রাণকে দোলা দিল। দেখতে পেলাম ইউরোপের অনেক পর্যটক বড় বড় ক্যামেরা তাক করে ঢেউকে বন্দী করতে ব্যস্ত। আমরা মিষ্টি কিছু হাওয়া নিয়ে চললাম বোরকার দোকানে।
কালবা শহরে বাঙালিদের অনেক বোরকার দোকান। স্থানীয় নারীরা হামেশা বোরকা বদল করে বলে এর কদর অনেক। বোরকার দোকানের কয়েকজন আমাদের পরিচিত। তাঁদের সঙ্গে দেখা করে রওনা হলাম প্রধান আকর্ষণ ফুজিরায় ফর ফুরকানের উদ্দেশে।

ফুরকান সমুদ্রসৈকত
ফুরকান সমুদ্রসৈকত


কালবা শহর থেকে ফুজিরা রোড হয়ে আমরা এসে ঢুকলাম ফর ফুরকান এ। গাড়ি থেকেই চোখে পড়ল প্যারাসুট নিয়ে রোমাঞ্চকর পর্যটকদের আনন্দ অবগাহন। আমরাও সাগরে গোসল করতে প্রস্তুতি নিলাম। ততক্ষণে সূর্য আকাশের বুকে লুকিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কক্সবাজারে সাগরের বুকে সূর্য হারায় আর এখানে আকাশে। এখানে সাগরকে পেছনে রেখে সূর্য লুকায় বলে তেমন মজা নেই। সাগরের তীরে পরিবার পরিজন নিয়ে স্থানীয় ও বিদেশিরা আসছেন। কেউ আমাদের মতো খাবার নিয়ে। কেউ আবার খাবার বানাচ্ছেন এখানে। বিশাল সাগর। ওপাশে ওমান। এ পাশে আরব আমিরাতের শেষ সীমানা। পাথরের পাহাড় যেন সাগরে গোসল করতে নেমেছে। সাগরের গর্জন আর মিষ্টি হাওয়া এই গরমের দেশে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষের প্রাণ জুড়ায়। আমরা ভলিবল নিয়ে খেলা শুরু করলাম দলবেঁধে। পরে অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে মন আর শরীর হালকা করে উঠলাম সাগরের বুক থেকে। এবার বেরিয়ে পড়লাম ইতিহাসের খোঁজে।

এবার ফুজিরা থেকে গেলাম পাঁচশ বছরে পুরনো মাটির মসজিদ দেখতে। মসজিদটির নাম আল বাদাইয়া বা আল বিদা মসজিদ। ফুজিরা শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর দিকে পাহাড়ের বুকে একটি ছোটগ্রামের মসজিদের গায়ে প্রতিষ্ঠা সাল লেখা নেই। তবে ধারণা করা হয় ইংরেজি ১৪৪৬ সালে এটি নির্মিত। ফুজিরাহ প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র ১৯৯৭ সালে এই তথ্য আবিষ্কার করে। সম্পূর্ণ মাটি দিয়ে তৈরি মসজিদটি পাথরের পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত। পাশে রয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন কুয়াও। মসজিদটিতে দরজা জানালা ছোট করে রাখা আছে। এখানে নামাজ পড়া হয়। এখন এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে ফুজিরার একটি আকর্ষণ।


জানা যায় এটি আরব আমিরাতের সবচেয়ে প্রাচীন এবং একমাত্র মাটির তৈরি সুনিপুণ মসজিদ। ছোট ও বর্গাকার (৫৩ বর্গ মিটার) এই মসজিদ নির্মাণের জন্য উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সাদা রঙের কাদামাটি। এর অনেক স্তর আস্তরণ। বিভিন্ন মাপের কাদা মাটির ইট পাথর থেকে নির্মিত হয়েছিল এই মসজিদ। এর নির্মাণ কৌশল স্থাপত্য শিল্পীদেরও ভাবায়।

মাসাফিতে মৃৎশিল্পের দোকান
মাসাফিতে মৃৎশিল্পের দোকান


মসজিদ দেখা শেষে আমরা আবার রওনা হলাম। দুদিকে পাথরের পাহাড়। নির্জন রাস্তা। পথে হঠাৎ আমাদের গাড়ি বিকল হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও ফল ব্যর্থ। কোনো উপায় না দেখে গাড়িতে থাকা পাটি বের করে আমরা পাশের মরুভূমিতে আরাম করতে লাগলাম। ওপরে খোলা আকাশ। পাশে খোলা জমিন। নেই গাছপালা। তবে কেমন জানি হাওর টাইপের হাওয়া এসে লাগছে আমাদের গায়ে। রাত তখন প্রায় ১১টা। জনমানবহীন এলাকা। কোথাও কেউ নেই! এই সময় এক পাঠান রিকভারি ভ্যান নিয়ে ওই এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের ডাকে সে সাড়া দিল। তাঁর ভ্যানে আমরা রওনা হলাম। আমরা গিয়েছিলাম ১২ সেপ্টেম্বর, আর ফিলমাম ১৩ সেপ্টেম্বর।
লুৎফুর রহমান
দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত