শ্বশুর বাড়িতে প্রথম ঈদ

তাঁদের কারও বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর, কারও ১০ বছর। কর্মক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থানে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে প্রথম ঈদে তাঁরা কী করেছিলেন, কেমন ছিল মা-বাবা-ভাইবোন ছাড়া প্রথম ঈদটি? আজ অধুনায় জানব তেমনই চার পেশাজীবী নারীর শ্বশুরবাড়িতে প্রথম ঈদের গল্প

রেবেকা সুলতানা, ছবি: খালেদ সরকার
রেবেকা সুলতানা, ছবি: খালেদ সরকার

 সবাই এল পুলিশ বউ দেখতে
রেবেকা সুলতানা
অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন্সপেক্টর জেনারেল (এআইজি) ক্রাইম-পশ্চিম, বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা

শ্বশুরবাড়িতে আমার প্রথম ঈদ ২০০৩ সালে। বলে রাখি, আমার ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে। ফলে ওই বাড়ির সবাইকে আগে থেকেই চিনতাম। যদিও বিয়ের পর সবার সঙ্গে সম্পর্ক পরিবর্তন হয়েছে। বিয়ের আগে আমার ফুফাতো বোনেরা আপা ডাকত, বিয়ের পর ভাবি। আমার স্বামীর গ্রামের বাড়ি বরিশালে। ঢাকা থেকে লঞ্চ, ট্রলার আর নৌকা—এই তিন জলযানে চড়ে সেখানে পৌঁছালাম ঈদের আগের দিন। সেটা ছিল কোরবানির ঈদ।

গ্রামের মানুষ পুলিশ বউ দেখতে এসেছে। তাদের চোখে রাজ্যের কৌতূহল আর প্রশ্ন। কেউ বলে, ‘তুমি কি দারোগা, না তার চেয়ে বড়?’ কেউ বলে, ‘চোর ধরতে পারো?’ এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে মজাই লাগছিল।

ঈদে সারা দিন সবার সঙ্গে কথাবার্তা আর মেহমানদারি ছাড়াও টুকটাক ঘোরা হলো। ফুফু মানে আমার শাশুড়ি খুব আদর-যত্ন করেছিলেন। কারণ, মা-বাবা ছাড়া প্রথম ঈদ ছিল তো। সব মিলিয়ে ভালোই কেটেছিল। এখন স্বামী আর দুই মেয়েকে নিয়ে ঢাকাতেই কাটে ঈদের দিন।

শাশুড়ির সঙ্গে রান্না করেছি

নাফিসা হাবীব
নাফিসা হাবীব


নাফিসা হাবীব
ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট, ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড

২০০৩ সালে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর প্রথম ঈদ সাভারে শ্বশুরবাড়িতে করেছিলাম। সেটা ছিল রোজার ঈদ। আমি উপহার পেতে খুব পছন্দ করি। শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়রা অনেক উপহার দিয়েছিলেন। ঈদে একটা করে উপহার আসছিল আর শাশুড়ি ফোন করে জানাচ্ছিলেন। আমি আর আমার স্বামী বাজারে ঘুরে ঘুরে সবার জন্য কেনাকাটা করেছিলাম। চাকরির কারণে আমরা থাকতাম ঢাকার ইস্কাটনে। অফিস ছুটি হয়েছিল এক দিন আগে। ঈদের আগের দিন আমরা ট্যাক্সি ভাড়া করে সাভারে গিয়েছিলাম। চাঁদরাতে শাশুড়ির সঙ্গে মিলে রান্না করেছিলাম। বিয়ের আগে অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠতাম। শ্বশুরবাড়িতে ঈদের দিন অনেক সকালে উঠেছিলাম। অন্য রকম লাগছিল। আমার স্বামীর বড় বোনের দেওয়া সিল্কের শাড়ি পরেছিলাম। মা-বাবার কথাও খুব মনে পড়ছিল। বারবার ফোন করছিলাম। জানতে চাচ্ছিলাম তাঁরা কী করছেন। আমি একটু রাগী ধরনের। মা-বাবা দুজনই ফোনে বোঝাচ্ছিলেন আমি যেন কোনো কারণে রাগ না করি। মা তখনো বুঝে ওঠেননি যে মেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। রাগ করা তো দূরে থাক বরং বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে পেরে অনেক ভালো লাগছিল।

রুশদা শারমিন
রুশদা শারমিন

তরকারিতে লবণ বেশি হয়েছিল

রুশদা শারমিন

চিকিৎসা কর্মকর্তা, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল

২০০৮ সালে প্রথম ঈদ করি শ্বশুরবাড়িতে। সেটা ছিল রোজার ঈদ। ভালোই লেগেছিল। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মা-বাবার জন্য খুব খারাপও লেগেছে। চাঁদরাত থেকেই মায়ের জন্য খারাপ লেগেছিল। ঈদের দিন খুঁটিনাটি সব বিষয় নিয়ে আমি আর মা পরিকল্পনা করতাম। শ্বশুরবাড়িতে আমি মুখে কিছু না বললেও আমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল। প্রথম ঈদে আমি শাশুড়ির সঙ্গে মিলে রান্না করেছিলাম। ওটা ছিল আমার জীবনে করা দ্বিতীয় বা তৃতীয় রান্না। পুডিং ও মুরগির একটা পদ রান্না করেছিলাম। তাতে একটু লবণ বেশি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সবাই খেয়ে খুব প্রশংসা করেছিল। প্রথম ঈদে সবচেয়ে ভালো লেগেছিল স্বামীর কাছ থেকে শাড়ি পেয়ে। আমার স্বামী খুবই ঘরকুনো। কখনোই কেনাকাটায় থাকেন না। কিন্তু প্রথম ঈদে আমাকে চমকে দেওয়ার জন্য নিজে গিয়ে শাড়ি কিনে নিয়ে এসেছিলেন। এটা আমার জন্য বিশাল বিষয় ছিল। ঈদের সময় নিজের বাড়িতে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হতো। কিন্তু এখানে আমার শাশুড়ি সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রতিটা কাজেই আমাকে খুব সাহায্য করেছিলেন, যাতে কোনো কাজ নিয়ে আমি কোনো রকম চাপ অনুভব না করি।

আমার বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেছে। আমার একটা মেয়ে আছে আড়াই বছরের। আমার শ্বশুর মারা গেছেন অনেক দিন হলো। স্বামী চিকিৎসক। শাশুড়িও চিকিৎসক। এ কারণে সবাই খুব ব্যস্ত থাকি।

ঈদে শাশুড়ি ও আমি একই রকম শাড়ি পরি

ফারিয়েল আহমেদ
ফারিয়েল আহমেদ


ফারিয়েল আহমেদ
ফাস্ট অফিসার, এয়ারবাস-৩১০
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস
বিয়ের আগে ঈদে মা-বাবাসহ পরিবারের অন্যদের সঙ্গে মজা করতাম। বিকেলে বেড়াতে যেতাম বন্ধুদের সঙ্গে। আমি যখন ট্রেইনি পাইলট, তখনো আমার বিয়ে হয়নি। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর বিয়ের পিঁড়িতে বসেছি। আমার স্বামী (জাহিদ হোসেন) আর আমি একই পেশায় আছি। শ্বশুর-শাশুড়ির তিন ছেলের মধ্যে আমার স্বামী দ্বিতীয় হলেও আমি বাড়ির প্রথম বউ। তাই আমার অভিজ্ঞতা একেবারেই অন্য রকম। বিয়ের প্রায় ১০ মাস পর প্রথম ঈদ করেছিলাম শ্বশুরবাড়িতে। তবে সেদিন মনে হয়েছে আমি যেন নতুন বউ। সবাই আমাকে উপহার দিয়েছে। ঈদের দিন আমি কী শাড়ি পরছি বা কী খাব, সেটা সবাই আলাদা করে জানতে চেয়েছে। আমি নখে নেইলপলিশ দিয়েছি, সেটিও বাড়ির সবাই এমন করে দেখেছে; যেন এর আগে তারা আমাকে নেইলপলিশ দেওয়া দেখেনি। অনেক মজা পেতাম। এই বাড়িতে কোনো মেয়ে না থাকায় সবাই আমাকে নিয়ে এমন শুরু করল যে অন্য কিছু ভাবার সময়ই পেতাম না। এখনো তেমনই হয়। তবে এখন আমিও সবার জন্য উপহার কিনি। আমাদের একটা বাচ্চা হয়েছে। ওর বয়স দেড় বছর। এখন আমরা আলাদা বাসায় থাকি। তবে ঈদের দিন যদি ফ্লাইট না থাকে, তাহলে বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি দুই জায়গায়ই যাওয়া হয়। আরেকটা মজার কথা হলো, বিয়ের পর থেকে ঈদের দিন আমার শাশুড়ি ও আমি একই রকম শাড়ি পরি।