ঈদের খুশি আসে সাইকেলে চড়ে

বিডিসাইক্লিস্ট—নিছক সাইকেল আরোহীদের দল নয়। দুই চাকায় চেপে তাঁরা ঈদের খুশি পৌঁছে দেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে। জানাচ্ছেন আবুল হাসনাত

ঈদের সময় সাইকেলে চেপে ছিন্নমূল মানুষের কাছে এভাবেই বিভিন্ন উপহার পৌঁছে দেন বিডিসাইক্লিেস্টর সদস্যরা
ঈদের সময় সাইকেলে চেপে ছিন্নমূল মানুষের কাছে এভাবেই বিভিন্ন উপহার পৌঁছে দেন বিডিসাইক্লিেস্টর সদস্যরা

কাকডাকা ভোর। চারদিকে সুনসান নীরবতা। মাঝেমধ্যে দু-একটা গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে ৬০-৭০টি সাইকেল সন্তর্পণে এগোয়। আরোহীদের সবার কাঁধে ব্যাগ। কিছুদূর গিয়ে ফুটপাত ঘেঁষে থামলেন সবাই।
পাশেই খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে ছিন্নমূল মানুষগুলো। সাইকেল আরোহীদের ব্যাগ থেকে একটা একটা করে জিনিস বেরোয়। কেউ বের করেন নিপাট শাড়ি, কারও হাতে নতুন পাঞ্জাবি, কেউবা বের করেন লুঙ্গি। একজন তো সঙ্গে করে সেমাই, দুধ, চিনি নিয়ে এসেছেন। ঈদের দিন, একটু ভালোমন্দ খাবে গরিব মানুষগুলো, এই হয়তো তাঁর ভাবনা। আরেকজন ঘুমন্ত একটা বাচ্চার পাশে একমুঠো চকলেট রাখলেন। অন্যজন রাখলেন র্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা খেলনা।
ঘুমন্ত মানুষগুলোর পাশে একে একে এভাবেই উপহার সামগ্রী রাখেন সাইকেল আরোহীরা। কেউ আস্তে করে ডেকে উপহারের প্যাকেটটা হাতে ধরিয়ে দেন। পরোক্ষণেই ছুট দেন অন্য পাশে। মানুষের কোলাহল বাড়ার আগেই চুপিসারে কাজটি সেরে নেন সবাই।
এ গল্পগুলো বিডিসাইক্লিস্টদের। নিজেদের নানা সামাজিক উদ্যোগের পাশাপাশি ঈদের সময় সাইকেলে চেপে ছিন্নমূল মানুষের কাছে তাঁরা পৌঁছে দেন বিভিন্ন উপহার। এই রেওয়াজকে তাঁরা বলেন ‘ঈদ মোবারক রাইড’। পিঠে উপহারের বোঝা নিয়ে আসন্ন কোরবানির ঈদেও তাঁরা বেরোবেন।
‘কাজটি করতে গিয়ে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। ঈদের দিন, সাতসকালে ঘুম ভেঙে হাতে নতুন শাড়ি বা লুঙ্গি পেয়ে একেকটা মানুষ যে কী খুশি হয়, তা বলে বোঝানো যাবে না। কেউ কেউ বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। একবার এক বৃদ্ধা আবেগাপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন।’ বলছিলেন বিডিসাইক্লিস্টের অন্যতম মডারেটর ফুয়াদ আহসান চৌধুরী।
নীরবে-নিভৃতে কাজ করেন বিডিসাইক্লিস্টসের তরুণেরা। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে অন্যের জন্য ভালো কিছু করেন তাঁরা। তবে তাঁদের মূল কাজ সাইকেল চালানো।
চারদেয়ালে বন্দী নাগরিকজীবনে সুস্থ-সবল দেহ-মন আর মজা করে বাঁচার প্রত্যয় নিয়ে ২০১১ সালের মে মাস থেকে সংগঠনটির যাত্রা শুরু। মাত্র তিন বছরের মাথায় ফেসবুক গ্রুপে এর সদস্যসংখ্যা এখন ৪৪ হাজার ৮০০ জন। ছেলে-বুড়ো, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সব শ্রেিণ-পেশার মানুষ আছেন এখানে। সবার উদ্দেশ্য একটাই—নিজে ভালো থাকা, অন্যকে ভালো রাখা। অন্যদের ভালো রাখতে গিয়েই ‘গুড অ্যাক্টস’র প্রবর্তন।

দু-চাকায় সারা দেশ
‘গুড অ্যাক্টসটা আমাদের সব কর্মকাণ্ডের মধ্যে পুরোনো। সাইকেলে করে একটা জায়গায় আমরা যাই এবং মজা করি। পাশাপাশি একটা ভালো কাজ করে আসি। এটাই গুড অ্যাক্টস। আসলে গুড অ্যাক্টসের কোনো সংজ্ঞা নেই।’ বলছিলেন বিডিসাইক্লিস্টসের আরেক মডারেটর দ্রাবিড় আলম।
ভালো কাজের উদাহরণ টানতে গিয়ে দ্রাবিড় বলেন, টাঙ্গাইলে দরিদ্র একটি পরিবারকে দুটি গরু দিয়েছিলেন তাঁরা। আরেকবার গেলেন টেকনাফে। সেখানে একটি স্কুলে বাচ্চাদের একগাদা কলম, পেনসিল বক্স, জামা-কাপড় দিয়ে এলেন।
মাঝখানে ঢাকা থেকে সাইকেল চালিয়ে পাবনাতেও গিয়েছিলেন তাঁরা কয়েকজন। দুই পরিবারকে দুটি ভ্যান কিনে দিয়েছিলেন সেবার। আরেকজনকে চিকিৎসা খরচের জন্য দিয়েছিলেন ১০ হাজার টাকা। এভাবে জেলায় জেলায় ঘুরে চলে সিক্সটি ফোর গুড অ্যাক্টসের কাজ-কারবার। যখনই সময়-সুযোগ হয় নেমে পড়েন সাইকেল নিয়ে। ধরাবাধা কোনো নিয়ম নেই।
দুর্যোগেও অসহায় মানুষের পাশে থাকে বিডিসাইক্লিস্টস। যেমনটা ছিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে। যানজট ঠেলে মাত্র ৪৫ মিনিটে চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে তাঁরা পৌঁছে যেতেন সাভারে।

দুনিয়া চক্কর
সাইকেল চালানোটাকে বৈচিত্র্যময় করে তুলতে মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রমী কিছু উদ্যোগ নেয় বিডিসাইক্লিস্টস। এরই একটি ‘সাইকেল দ্য ওয়ার্ল্ড ৪০,০৭৫ কিমি’। সোজাকথায় সাইকেলে দুনিয়া চক্কর। গোল পৃথিবীটাকে এক চক্কর দিয়ে এলে ওই পরিমাণ পথ পাড়ি দিতে হবে। আক্ষরিক অর্থে দুনিয়া চক্কর নয়। রাস্তায় সাইকেল চালালেই হলো। তবে কি না, কাজটা করতে হবে সবাই মিলে। সময় এক মাসের একটু বেশি। সফল হলে প্রতি কিলোমিটারের জন্য প্রত্যেক সাইক্লিস্ট পাবেন ১০ টাকা। টাকাটা জমা হবে শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থার তহবিলে। অর্থাৎ ৪০ হাজার ৭৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারলে চার লাখ ৭৫ হাজার টাকা জমা পড়বে তহবিলে। টাকাটা দেবে এ দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠান। ব্যয় হবে শিশুদের জন্যই।
দুনিয়া চক্করের চ্যালেঞ্জটা বিডিসাইক্লিস্টসের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন তরুণেরা। মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় টার্গেট ছুঁয়ে ফেললেন তাঁরা। আর মাস শেষে (১৮ সেপ্টেম্বর) দেখা গেল, প্রায় তিন গুণ অর্থাৎ এক লাখ ১৬ হাজার ২৬২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া হয়ে গেছে।
সামনে আরও বিস্তর পথ পাড়ি দেয়ার ইচ্ছা তাঁদের। নাগরিক জীবনে বিডিসাইক্লিস্ট যেমন নতুন একটি ধারার সৃষ্টি করেছে, তেমনি ঈদসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও এ দলটি অগ্রণী।

বিডিসাইক্লিেস্টর সদস্যরা। ছবি: সংগ্রহ
বিডিসাইক্লিেস্টর সদস্যরা। ছবি: সংগ্রহ