প্রবাসজীবনের ইতি টানছেন সাবরিনা-রিংকি

প্রবাসজীবন থেকে দেশে ফিরছেন রিংকি-সাবরিনা দম্পতি। ছবি: প্রথম আলো
প্রবাসজীবন থেকে দেশে ফিরছেন রিংকি-সাবরিনা দম্পতি। ছবি: প্রথম আলো

আটলান্টা শহর কি জানত এই পোড় খাওয়া মানুষটি কে? আজ থেকে ১৮ বছর আগে বাংলাদেশের এক তরুণ আটলান্টায় এসেছিলেন বুকভরা আবেগ নিয়ে। আটলান্টা অলিম্পিক গেমসে বাংলাদেশের পতাকা ছিল তাঁর হাতে। ১৮ বছর পরে সেই মানুষটি আটলান্টায় রয়েছেন ভাগ্যান্বেষণে। কাজ নিয়েছেন এক পিৎজার দোকানে, সামান্য কর্মচারী হিসেবে। কিন্তু গৌরবের জীবন ছেড়ে এই অনুজ্জ্বল জীবন তাঁর ভালো লাগবে কেন? তাই এবার পাততাড়ি গোটানোর পালা। অভিবাসী জীবনকে পেছনে ফেলে ৩০ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে যাচ্ছেন দেশের এককালের সেরা শ্যুটার সাইফুল আলম চৌধুরী রিংকি ও সাবরিনা সুলতানা দম্পতি। যে স্বপ্ন নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছিলেন, সেটা পূর্ণ না হওয়ায় এবার তাঁরা ফিরছেন নিজ ভূমিতে।
আটলান্টা থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে নিউইয়র্কে পাঁচ দিনের যাত্রাবিরতি করেছিলেন এই শ্যুটার দম্পতি। সঙ্গে তাঁদের দুই ছেলে। তখন তাঁদের সঙ্গে অনেক কথাই হলো। তাঁদের কণ্ঠে ছিল আশা পূর্ণ না হওয়ার আক্ষেপ। অবৈধ অভিবাসী হয়ে এ দেশে থাকতে চান না বলেই ফিরে যাচ্ছেন দেশে। তবে একেবারে খালি হাতে দেশে ফিরছেন না তাঁরা। এ বছরই, ২৩ মার্চ আটলান্টায় জন্ম নিয়েছে এই দম্পতির দ্বিতীয় পুত্র রাফকাত চৌধুরী রাফি। ২০০৪ সালে জন্ম নিয়েছিল প্রথম পুত্র রনক চৌধুরী। আমেরিকায় এসেছিলেন এক সন্তান নিয়ে। ফিরছেন দুই সন্তান নিয়ে। চেষ্টা চালিয়েছিলেন অভিবাসনের কাগজপত্র হাতে নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকতে, কিন্তু এ-সংক্রান্ত কোনো ফয়সালা না হওয়ায় আমেরিকায় কেবল থাকার জন্য থাকতে চাননি, দেশে ফিরে যাওয়কেই শ্রেয় মনে করেছেন। তবে স্বপ্ন হারিয়ে যায়নি তাঁদের চোখ থেকে। এ দেশে জন্ম হওয়ায় ছোট সন্তানটি শুধু আমেরিকার পাসপোর্টধারী। ২১ বছর পূর্ণ হলে সে-ই নাহয় আবার আমেরিকায় নিয়ে যাবে বুড়ো মা-বাবাকে।
এ দেশের ক্রীড়া ইতিহাসে রিংকি-সাবরিনা দম্পতিকে একটা বিশেষ জায়গা দিতেই হচ্ছে। আগেই তো বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে আটলান্টা অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশের পতাকার গৌরব বহন করেছিলেন রিংকি, ২০০০ সালে স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সিডনি অলিম্পিকে দেশের পতাকা কাঁধে নিয়েছিলেন সাবরিনা। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এমন সফল দম্পতি আর দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু দেশে প্রাপ্য মূল্যায়ন ​কি তাঁরা পেয়েছেন? এ প্রশ্নে ‘না’ বাচক উত্তরই বেরিয়ে আসবে চরম হতাশা ছড়িয়ে।
শ্যুটিং একটা সময় দেশকে অনেক সাফল্যই উপহার দিয়েছিল। কিন্তু সেগুলো এখন ইতিহাসেরই অংশ। যে শ্যুটারদের সাফল্যের ওপর দাঁড়িয়ে শ্যুটিং ফেডারেশন, তার কার্যনির্বাহী কমিটিতে কজন সাবেক শ্যুটার? সংখ্যাটা যখন কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নামে, তখন তো বেদনা জাগবেই। নিজ দেশে কদর না মেলাতে এভাবে দেশ ছেড়ে বিদেশে সংগ্রামের, কখনো অসম্মানের জীবন বেছে নেন খেলোয়াড়েরা।
গত এক দশকে শ্যুটারদের মধ্যে যাঁরা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছেন আটলান্টাকে। শহরটিতে এখন দেশের অনেক সাবেক শ্যুটারেরই বাস। রিংকি ওখানে কাজ করতেন নজরুল ইসলাম রুবেল নামের একজন প্রাক্তন শ্যুটারের পিৎ​জার দোকানে। দেশসেরা আরেক শ্যুটার ও কোচ শোয়েবুজ্জামানও ওখানেও কাজ করেন। শ্যুটিং ফেডারেশনের জনৈক কর্মকর্তার রোষানলে পড়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে শোয়েবকে। দেশসেরা আরও এক শ্যুটার দম্পতি নাসিরউদ্দিন জনি ও সাবরিনা রহমান সাগরও এই শহরে থাকেন। রিংকির এক বোনও থাকেন এখানে। তিনিও শ্যুটার ছিলেন। তাই বিশেষভাবে আটলান্টায় থাকার কথা জানালেন এ দম্পতি।
২০১৩ সালের নভেম্বরে আমেরিকায় এসেছেন রিংকি-সাবরিনা। আমেরিকার ভিসা পেয়েছিলেন এক বছর আগেই। তবে এখানে আসাটা হঠাৎ করেই। রিংকি তাঁর বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। তারপর সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য থেকেই যান। নভেম্বরে আমেরিকায় আসার পরে একবার দেশে গিয়েছিলেন রিংকি। যাওয়ার আগে নবজাতক শিশুসন্তানের কথা জানিয়ে আরও ভিসার সময় বাড়ানোর আবেদন করেন। অবৈধভাবে এখানে থাকতে চান না এ দম্পতি, ‘ইমিগ্র্যান্ট না হলে এখানে থেকে কী লাভ বলুন? মাঝখান থেকে ভিসাটা নষ্ট হয়ে যাবে। ছেলেমেয়েদের জন্য এ দেশটা খুব ভালো, ঠিক আছে। কিন্তু অবৈধভাবে তো থাকা যাবে না। তাই ঠিক করলাম দেশে ফিরে যাব। সেখানে গিয়েই সিদ্ধান্ত নেব, কী করা যায় সামনের দিনগুলোতে।’
রিংকি ও সাবরিনা দুজনই জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের শ্যুটিংয়ের স্বর্ণালি সময়ে খেলেছেন রিংকি। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাফ গেমসে এয়ার রাইফেলের ব্যক্তিগত ও দলগত—দুই ইভেন্টেই দেশকে সোনার পদক উপহার দিয়েছিলেন রিংকি। ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমসে আগেরবারের দুটো সোনা তো অক্ষুণ্ন রাখেনই উল্টো আরও একটি সোনা জেতেন অপর একটি ইভেন্টে। সাফ গেমসে পরপর দুই আসরে নিজের সোনার পদক ধরে রাখার রেকর্ড বাংলাদেশে আছে কেবল তিনজনের। একজন তো রিংকি অবশ্যই, অপর দুজন হলেন প্রয়াত অ্যাথলেট শাহ আলম আর সাঁতারু মোশাররফ হোসেনের। সাফ গেমসের বাইরেও সাফ শ্যুটিংয়ের বিভিন্ন আসরে দেশকে আরও ছয়বার সোনার পদক উপহার দিয়েছেন কুষ্টিয়ার এই শ্যুটার।
নব্বইয়ের দশকে ভারতকে পেছনে ফেলে দক্ষিণ এশীয় শ্যুটিংয়ে সবার আগে উচ্চারিত হতো বাংলাদেশের নাম। এখন আর সেদিন নেই। ভারত সাফ গেমসকে পেছনে ফেলেছে অনেক আগেই। তাঁরা এখন অলিম্পিকেও সাফল্য পায়। কিন্তু বাংলাদেশে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের শ্যুটাররা যেন হারিয়ে খুঁজছেন নিজেদের। বিষয়টা নাড়া দেয় রিংকিকে। যে দেশে তাঁদের মতো শ্যুটারের মূল্যায়ন নেই, সেখানে কত দূরই বা যেতে পারবে খেলাটি? রিংকির মতো সাবরিনারও এ খেলাটির প্রতি অবদান অনেক। বছরের পর বছর, দিন নেই রাত নেই অনুশীলন করে গেছেন শ্যুটিং রেঞ্জে। কখনোই বিচ্যুত হতে চাননি নিজের অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে। একসময় তাঁকে ডাকা হতো বাংলাদেশের ‘স্বর্ণকন্যা’। ১৯৯৭ সালে কমনওয়েলথ শ্যুটিংয়ে সোনা জিতেছিলেন তিনি। সাবরিনার ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য এটাই। এর বাইরে ১৯৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে আর ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু সাফ গেমসে প্রনের দলগত ইভেন্ট সোনা জিতেছিলেন তিনি। সাফ গেমসের বাইরে সার্ক শ্যুটিংয়ে তাঁর সোনা আছে মোট ছয়বার।
আটলান্টার জীবন ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে কেমন লাগবে? সাবরিনা হেসে বললেন, ‘এমনিতে এখানে সবকিছুই ভালো লাগে। বাংলাদেশের তুলনায় এখানে জীবনযাত্রা অনেক বেশি ভালো, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। যানজট, ধুলোবালি নেই। ছিনতাইয়ের ভয় নেই। জীবনযাত্রা অনেক বেশি নিরাপদ আর সহজ। তবে আত্মীয়-পরিজনদের ছেড়ে এভাবে পড়ে থাকতে খুব খারাপ লাগে।’ আটলান্টার জর্জিয়ার ফেয়ারবানে থাকতেন এ দম্পতি। নিউইয়র্কের মতো সেখানে বেশি দোকানপাটও নেই। কিছু কিনতে হলে যেতে হয় অনেক দূরে। নিজস্ব গাড়ি না থাকলে চলাফেরা করাও কঠিন। তারপর সব কাজ নিজেরই করতে হয়। সন্তান জন্ম দিয়ে বাসায় ফেরার পরের দিনই সাবরিনাকে রান্না করতে হয়েছে স্বামী-সন্তানের জন্য। দেশে থাকলে কী এরকম হতো? মোটেই না।
প্রবাসজীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির কথা জানাতে গিয়ে সাবরিনা জানালেন, ‘আমার বড় ছেলেটি এখন অনেক বেশি দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ছোট ভাই হওয়ার পরে রাতারাতি অনেক বড় হয়ে গেছে সে। ওর পরিবর্তন দেখে রিংকি-সাবরিনা রীতিমতো অবাক। শিশু ভাইকে লালন-পালন করতে মেয়েরা মাকে যেভাবে সাহায্য করে, রনকও নাকি সেটাই করে। ভাইয়ের কাপড় গুছিয়ে রাখে। ডায়াপার পাল্টে দেয়। দুধ খাইয়ে দেয়। মা রান্না ঘরে কাজ করলে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়। তা ছাড়া ঘরের কাজও নাকি করে রনক। নিজেই সব আবর্জনা ব্যাগে ভরে গারবেজে ফেলে আসে। সাবরিনাকে আর বলে দিতে হয় না। অথচ ছোট ভাই হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত রনককে আদর করে বিছানা থেকে ওঠাতে হয়েছে। হাত দিয়ে খাইয়ে দিতে হয়েছে।
ঢাকার রামপুরা বাসা এখনো ছাড়েননি রিংকি-সাবরিনা। দেশে ফিরে পারিবারিক ব্যবসায় মনোযোগ দেওয়ার ইচ্ছা রিংকির। আবার শ্যুটিংয়ে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা আছে সাবরিনার। কোচ হিসেবে কাজ করতে চান তিনি। ঢাকায় থাকলে সন্তান লালনপালনে মায়ের সহযোগিতা পাবেন। সবকিছুই হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত শ্যুটিং ফেডারেশনের কাছ থেকে নিজেদের যোগ্যতার মূল্যায়ন ​কি তাঁরা পাবেন?