এ ভার তাঁর একার নয়

প্রতিবাদের অস্ত্র তোশকসহ এমা সালকোভিচ
প্রতিবাদের অস্ত্র তোশকসহ এমা সালকোভিচ

তোশক হাতে একলা নারী, এই দৃশ্যটি কোনো অ্যাবসার্ডিস্ট নাটকের এক মুহূর্ত মনে হতে পারে। কিন্তু এ কোনো নাটকের দৃশ্য নয়। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে এলে আপনার হয়তো চোখে পড়বে হালকা-পাতলা শ্বেতকায় একটি মেয়ে, কখনো একা, কখনো কোনো সহপাঠীকে নিয়ে একটি তোশক বয়ে বেড়াচ্ছেন। ঘন নীল রঙের চাদরে মোড়া এক শয্যার তোশক, ঠিক যে রকম সচরাচর এ দেশের ছাত্রাবাসে মেলে।
মেয়েটির নাম এমা সালকোভিচ, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্বের শেষ বর্ষের ছাত্রী। দুই বছর আগে যখন তিনি দ্বিতীয় বর্ষে, এমা তাঁর পরিচিত এক সহপাঠী কর্তৃক ধর্ষিত হন। ঘটনাটি এত আকস্মিক, এত অপ্রত্যাশিত যে এমা সংবিৎ হারিয়ে ফেলেন। এরপর নীরবই ছিলেন দীর্ঘদিন। পরে নিজের ভেতর বোঝাপড়া শেষে এ নিয়ে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পরে পুলিশের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করেন। উভয় ক্ষেত্র থেকেই সাহায্য লাভে ব্যর্থ হন এমা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছেলেটির দাবি সমর্থন করে রায় দেয়, সম্মতির ভিত্তিতে যৌন সম্পর্ক হয়েছে। আর এমার অভিযোগ হেসেই উড়িয়ে দেয় পুলিশ।
কিন্তু এমাকে নীরব রাখা যায়নি। ওই তোশক তাঁর প্রতিবাদ। ২০১৫ সালে শিক্ষাবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত যেখানেই তিনি যাবেন, সঙ্গে থাকবে ওই তোশক। এমা শিল্পকলার ছাত্রী। এই তোশকটি তিনি একটি অভিনয় শিল্পকর্ম হিসেবে উপস্থিত করেছেন, পরীক্ষায় তাঁর প্রদেয় শিল্পকর্মের অংশ হিসেবে।
এটি দৃষ্টিনন্দন কোনো শিল্পকর্ম নয়। কিন্তু শিল্পকর্মের কাজ শুধু দৃষ্টিনন্দন নয়, চেতনায় ও বিবেকে আগুন জ্বলানোও তার কাজ। সাহসী প্রতিবাদ হিসেবেই এমার তোশকটি সবার নজর কেড়েছে।
পৃথিবীর সর্বত্রই ছাত্রীরা সহপাঠী ছাত্র অথবা শিক্ষক, যার অনেকে তাঁদের পরিচিত, এমনকি ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাঁদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দোষ পড়ে মেয়েদের ওপর। ‘নিশ্চয় মেয়েটি উৎসাহ দিয়েছিল, অথবা উত্তেজক পোশাক পরেছিল’—এমন যুক্তি হরহামেশাই দেখানো হয়। ফলে, অভিযোগ করতে এসে উল্টো পরিহাসের শিকার হন মেয়েরা। সেই বিপদের কথা জেনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীরব থাকেন মেয়েরা।
এমা থাকেননি। তোশকটি তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। শুধু প্রতীক নয়, এমা চান এটিকে ‘পারফরমেন্স আর্ট’ হিসেবে বিচার করা হোক। শিল্পের যে অমিত শক্তি আছে, শিল্পের আড়ালে থেকেও সে প্রবলভাবে আমাদের উৎকণ্ঠা, ভীতি ও একাকীত্বের বেদনা প্রকাশে সক্ষম, এমার ওই সামান্য তোশক তার প্রমাণ। কেবল একখানি তোশক, যার অন্য কোনো আভরণ নেই, কোনো অলংকরণ নেই।
মানছি, পেছনের ইতিহাসটি না জানা থাকলে শুধু এই তোশক দেখে তাকে শিল্পকর্ম ভাবা, অথবা তার প্রতীকী প্রকাশের উপলব্ধি নির্ণয় সহজ নয়। আমরা যদি বুঝতে সক্ষম হই যে এই তোশকের ভার মেয়েটি বহন করে চলেছেন, তার ভেতর দিয়ে তিনি জানাচ্ছেন তাঁর অতি ব্যক্তিগত ও গোপন একটি ক্ষতের সংবাদ, তাহলে এই শিল্পকর্মের তাৎপর্য সম্পূর্ণ বদলে যায়। এই তোশক এমা অথবা তাঁর মতো অন্য সব মেয়ের নিজের দেহের মতোই একান্ত ব্যক্তিগত, একান্ত নিজস্ব। এখানে যা কিছু ঘটে, অনুমতি ছাড়া অন্য কারোর সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু ব্যক্তিগতের বর্ম ভেঙে সেখানে ঘটেছে এক নির্মম ঘটনা। সে ঘটনা এত দিন ছিল লুকানো, লজ্জা ও সংস্কারের দেয়ালে ছাওয়া। এমা নিজে সে দেয়াল ভেঙে ফেলেছেন। কোনো কথা না বলে, একটি শব্দ উচ্চারণ না করে তিনি আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, দেখো, কী গোপন ক্ষত আমি এত দিন বয়ে চলেছি। এখন তোমরা যারা এর দর্শক, তারাও সে ক্ষতের অংশীদার হতে পারো। যদি চাও, আমার পাশে এসে দাঁড়াতে পারো। আমাকে এই তোশক টেনে চলতে সাহায্য করতে পারো। যদি না চাও, ক্ষতি নেই। আমি নিজেই বইব সে ভার।
এভাবে তোশকের প্রতীকে ব্যক্তিগত ও সাধারণ—প্রাইভেট ও পাবলিক এক হয়ে যায়। এমা ‘ব্যক্তিগত’ এই মোড়কটি ছুড়ে ফেলে তাঁকে জনসমক্ষে নিয়ে এসেছেন। তিনি যখন ক্যাম্পাসের ভেতর তোশকটি নিয়ে হাঁটেন, অনেক সময়েই চেনা-অচেনা কোনো ছেলে বা মেয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। প্রতিবাদের অস্ত্র যা ছিল একা এমার, এর ফলে তা হয়ে পড়ে আরও অনেকের। চোখে চেয়ে দেখার সঙ্গে যুক্ত হয় স্পর্শ, ভারবহনের কারণে ঘটে শারীরিক সংযুক্তি। শিল্পকর্ম ব্যবহারিক হতে পারে, ফরাসি চিত্রকর দুশঁার চেয়ার, টেবিল বা সাইকেল বানিয়ে সে কথার প্রমাণ অনেক আগেই রেখেছেন। এমা এখানে তার সঙ্গে যা যুক্ত করলেন, তা হলো শিল্পকর্মকে একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত অভিজ্ঞতার প্রতিফলক হিসেবে উপস্থাপন, দর্শন ও স্পর্শের মিলিত নন্দন।
এমার এই তোশক, যার নাম ‘ক্যারি দ্যাট ওয়েট’ বা ‘বহন করো সেই ভার’, তার একটা বড় ফল হয়েছে এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ধর্ষণের শিকার আরও অনেক ছাত্রী এখন নিজেদের অভিজ্ঞতার বিবরণ নিয়ে প্রকাশ্যে আসা শুরু করেছেন। দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায়ও এ নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়েছে। কলাম্বিয়া কর্তৃপক্ষ এত দিন পুরো ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। এমন নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে এমন ঘটনা অহরহ ঘটে, সে কথা প্রচারিত হোক, তারা চায়নি। এমার কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বীকার করতে হচ্ছে, ক্যাম্পাসে যৌন নির্যাতন একটি সমস্যা। তা ঠেকানোর জন্য আর কী ব্যবস্থা তারা নিতে পারে, সারা ক্যাম্পাসেই ব্যাপক আলাপ-আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে।
পুরুষদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়ছে। ধর্ষণের সমস্যা একা মেয়েদের নয়, সমাজের সবার, সে কথার স্বীকৃতি বাড়ছে। যেকোনো দিন কলাম্বিয়াতে এসে দেখুন, হয়তো দেখবেন, এমার পাশাপাশি তাঁর তোশকটি নিয়ে যাঁরা হাঁটছেন, তাঁদের অনেকেই পুরুষ। কোনো উচ্চারণ ছাড়া সেই পুরুষ বলে দিচ্ছেন, ‘নারী, এই ভার তোমার একার নয়, আমারও।’