গুল মাকাই থেকে মালালা হয়ে ওঠা

পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার অচেনা এক কিশোরী কীভাবে হয়ে উঠলেন আজকের মালালা? সেই অজানা কাহিনি শোনাচ্ছেন বিবিসির এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়া বিভাগের নির্বাহী সম্পাদক নাজেস আফরোজ

মালালা ইউসুফজাই
মালালা ইউসুফজাই

গুল মাকাই ডায়েরি লিখত, প্রতিদিন। মাত্র তিন-চার স্তবক, কখনো একটি-দুটি। নিতান্ত বালিকাসুলভ ভাষায়, অতি সহজ-সরল জবানে লেখা সেই ডায়েরি। স্কুলে যেতে তার কতটা ভালো লাগে, তা লিখত। পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকা মিনগোরা থাকে সে। শহরে তালেবানি ফতোয়ার জন্য আর স্কুল যেতে পারবে কি না, সে বিষয় নিয়ে তার আশঙ্কার কথা বারবার ফুটে উঠেছে সেই রোজনামচাতে। রেডিওর মাধ্যমে বা পরিবারের বড়দের কাছ থেকে বাইরের পরিস্থিতি গুল মাকাই জানতে পারত। সে নিজের কাছেই জানতে চাইত, কেন ওর ভাই স্কুলে যেতে পারবে আর ও পারবে না। লিখত গোলাগুলির শব্দে রাতে ঘুম না হওয়ার বা দুঃস্বপ্নের কথা। বিবিসির উর্দু ওয়েবসাইটে শহরের কোনো মেয়ের এমন একটি ডায়েরি প্রকাশিত হচ্ছে আর তা নিয়ে বাজার-হাটে আলোচনা হচ্ছে, বাবার কাছে শুনে গুল মাকাই খুবই খুশি আর উত্তেজিত।
২০০৮ সালে মাওলানা ফজলুল্লাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানি তালেবানের একটি শাখা দেশের উত্তর-পশ্চিমের সোয়াত উপত্যকা দখল করে। পশতু জাতি-অধ্যুষিত এই উপত্যকা চিরকালই শিক্ষার দিকে থেকে পাকিস্তানের বাকি অংশের থেকে এগিয়ে। মেয়েদের শিক্ষার হার বরাবরই খুব উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের নীরব দর্শকজনিত ভূমিকার সুযোগ নিয়ে তালেবান সোয়াত উপত্যকাকে তাদের একটি মুক্তাঞ্চলে পরিণত করে তোলে এবং কট্টর ইসলামি শরিয়াহ আইন প্রণয়নের নামে মেয়েদের লেখাপড়া নিষিদ্ধ করে। একই সঙ্গে তারা প্রায় ১৫০টি স্কুল বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়, যেখানে মেয়েরা লেখাপড়া করতে যেত।
এই পরিস্থিতি মেয়েদের শিক্ষার ওপরে কী প্রভাব ফেলছে, সেটি জানার জন্য বিবিসির উর্দু ওয়েবসাইট একটি উদ্যোগ নেয়। সে উদ্যোগ থেকেই গুল মাকাইয়ের রোজনামচা শুরু। বিবিসির তৎকালীন দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়া বিভাগের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে এই বিশেষ সম্পাদকীয় উদ্যোগের পেছনে আমার কিছুটা ভূমিকা ছিল। সেই সময় বিবিসি উর্দু বিভাগের পেশোয়ার সংবাদদাতা তাঁর স্কুলশিক্ষক এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ১৩ বছরের মেয়েকে দিয়ে একটি ডায়েরি লেখানোর ব্যবস্থা করেন। যেহেতু একটি বালিকা এই ডায়েরির সঙ্গে যুক্ত, তাই বিবিসির নিয়ম অনুযায়ী সযত্নে তার পরিচয় গোপন রাখা হয়। সেই বালিকার ছদ্মনাম দেওয়া হয় গুল মাকাই। নামটি যে তার খুব পছন্দ, সেটাও বালিকাটি ডায়েরিতে জানাতে ভুল করেনি। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সারবস্তু এবং বিবিসির ইংরেজি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হওয়ার কারণে অচিরেই বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে সেই ডায়েরি সংবাদ হিসেবে জায়গা করে নেয়। বহু সংবাদপত্র ও ওয়েবসাইট সেই ডায়েরি নিয়মিত পুনঃপ্রকাশ করে। তিন মাস ধরে প্রকাশ করার সময় এই ডায়েরি পড়ে বুঝতে কোনো অসুবিধে হয়নি যে সে অতি বুদ্ধিমতী, সপ্রতিভ ও উৎসুক একটি কিশোরী।
এর পরে ২০১১ সালে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাই, মালালা ইউসুফজাই নামের এক কিশোরী নিয়মিত সাক্ষাৎকার দিচ্ছে, নানান অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে আর জানাচ্ছে যে সে-ই ছিল বিবিসি ডায়েরির গুল মাকাই। গুল মাকাইয়ের মালালা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের প্রচারের আলো ওর ওপর প্রবলভাবে এসে পড়ে। ওর এই আত্মপ্রকাশ দেখে চিন্তিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে কেন ওর পরিবার এমন সিদ্ধান্ত নিল। ওই ডায়েরি পাকিস্তানে বা বাইরে যে আলোড়ন ফেলেছিল, তাতে ওই পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো। স্কুল থেকে ফেরার পথে মালালা আর তার দুই বান্ধবী তালেবানের গুলিতে জখম হয়।

স্কুলের পথে
স্কুলের পথে

সুস্থ হয়ে উঠে ক্রিস্টিনা ল্যাম্বের সহযোগিতায় মালালা ওর আত্মজীবনী প্রকাশ করার পর আবার প্রচারের প্রখর আলোয় এসে পড়ে। প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তাঁর স্ত্রী মিশেলের আমন্ত্রণে মালালা হোয়াইট হাউসে গেছে; নিমন্ত্রণ পেয়েছে ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের কাছ থেকেও। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে মালালা মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে ভাষণ দিয়েছে; পৃথিবীর এমন কোনো টিভি চ্যানেল নেই, যেখানে ওর সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়নি।

হাসপাতালে মালালা
হাসপাতালে মালালা

অন্যদিকে, পাকিস্তানে চলছে মালালা এবং তার ওপর আক্রমণের ঘটনার পেছনে ষড়যন্ত্র খোঁজা। মালালাকে নাকি পশ্চিমি কোনো দেশের গুপ্তচরেরা শিশুবয়সে মিনগোরাতে রেখে গিয়েছিল ভবিষ্যতে পাকিস্তানের দুর্নাম করার জন্য। এমনকি এও বলা হচ্ছে যে ওই ঘটনা আদতেই ঘটেনি, মাথায় গুলি লাগা থেকে অস্ত্রোপচার—গোটাটাই সাজানো! পাকিস্তানি সমাজের এমনই করুণ অবস্থা যে এ ধরনের চরম আজগুবি সব গুজব আপাতনির্ভরযোগ্য প্রধান সংবাদপত্রে জায়গা পাচ্ছে। কিছু পাকিস্তানি সাংবাদিক মালালার বাবার উচ্চাশার কথাও উল্লেখ করে চলেছেন।
১৬ বছরের এক কিশোরীকে ঘিরে পশ্চিমি দেশগুলোর এই কাড়াকাড়ি উদ্দেশ্য নিয়ে গত বছর থেকেই বিতর্ক উঠেছে। এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর সেই বিতর্ক আরও বাড়ল। এরা ‘পিছিয়ে’ থাকা সমাজের একটি মেয়ের ‘মহান রক্ষাকর্তা’র ভূমিকা নিচ্ছে কি না, সেটা বিতর্কের একটি দিক। অন্যদিকে আছে অতি আলোচিত প্রসঙ্গ, পশ্চিমের সঙ্গে ইসলামের সংঘাতের ভৌগোলিক রাজনীতি। মালালা এখন বিশ্বরাজনীতির খেলায় একটি ঘুঁটিতে পরিণত হয়ে গেল কি না, তাও অনেককে ভাবাতে বাধ্য করছে।
ধর্মীয় মৌলবাদের মোকাবিলায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নতুন কিছু নয়। একই সঙ্গে ১৯৮০-র দশক থেকে পাকিস্তান-আফগানিস্তানে পশ্চিমের দেশগুলোর অতি সংকীর্ণ বিদেশ ও নিরাপত্তানীতি গোটা অঞ্চলকে অস্থির করে তুলেছে; শয়ে শয়ে মানুষকে কট্টর মৌলবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি শুধু মালালা নয়, আরও অনেক কিশোর-কিশোরীকে জীবন-মরণের মুখে এনে দাঁড় করাচ্ছে প্রতিদিন। বিশদে তো দূরস্থ, পাদটীকা হিসেবেও এরা কোনো প্রতিবেদনে স্থান পায় না। যেমন মালালার সঙ্গে ওর আরও যে দুই বান্ধবী তালেবানের গুলিতে জখম হয়েছিল, তাদের কোনো খবর কারও কাছে নেই।
কেন মালালাকে গুল মাকাই হিসেবে জনসমক্ষে আসতে হলো, আর কীভাবে ওই অঞ্চলের সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাধি দূর করা যায়, তা নিয়ে বিশেষ কোনো প্রয়াস চোখে পড়ে না। এটা না করে শুধু মালালাকে ধরেই পশ্চিমি জগতের প্রগতিশীল অংশ নিজেদের বিবেক দংশনের জ্বালা প্রশমন করছে, আর রাজনীতির হোতারা ‘ইসলাম বনাম পশ্চিমি সভ্যতা’র লড়াইয়ের যৌক্তিকতা খুবই সূক্ষ্মভাবে প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন।