এখন কোনো যানজট নেই

ছবিতে সামনে বসা মিনু-হাবিব৷ পেছনে দাঁড়িয়ে তিন ছেলে অনি, বনি ও রনি
ছবিতে সামনে বসা মিনু-হাবিব৷ পেছনে দাঁড়িয়ে তিন ছেলে অনি, বনি ও রনি

আমার ভাইটির এখন আর কোনো কষ্ট নেই। সব কষ্টের ভার আমদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সে চলে গেছে নিঃশব্দে। সারাজীবন যে লোকটা একমুহূর্তের জন্যে নিজের স্বার্থের দিকে তাকায়নি, সেই লোকটা শেষ ক্ষণেতে চরম স্বার্থপরের মতো একা একা চলে গেছে কোন সুদূরে—কে জানে। দেশ থেকে আমাদের পরিবারেরই একজন ই-মেইল পাঠিয়েছিল আমাকে, ‘হাবিবদার মুখটা যদি দেখতে পেতেন একবার দাদা, যেন একটা সদ্যফোটা পদ্মফুল। আশ্চর্য এক দিব্যজ্যোতিতে ভরা। যেন একটি তেলের প্রদীপ ভেসে চলেছে পরমাত্মার মহাপারাবারে।’
সদ্যফোটা ফুল! উপমাটি খুবই মামুলি, জানি। গ্রামের মেঠোপথের সোঁদা গন্ধ নিয়ে আসে যেন। কিন্তু মিলে যায় বেশ, প্রায় নিখুঁতভাবেই মিলে যায়। আমার এ-ভাইটির মতো নিখাদ নিষ্পাপ লোক আমি জীবনে দেখিনি। একসময় খুব হিংসে হতো আমার। আমি হাজার চেষ্টা করেও যা হতে পারিনি তাই সে থেকে গেল আজীবন। চেষ্টা করে, কষ্ট করে হয়েছিল তা নয়, ওর স্বভাবটাই ছিল ওরকম। জন্ম থেকেই। পাঠক হয়তো ভাবছেন খুব বোরিং একটা চরিত্র ছিলেন নিশ্চয়ই। নইলে এমন শ্বেতশুভ্র মানুষ হয় কী করে? নিয়ম-কানুনের বাইরে গিয়ে একআধটু আমোদফুর্তি আর হইহল্লা ছাড়া মানুষ বাঁচে কেমন করে? কিন্তু বেঁচে সে ছিল ঠিকই, আমাদের অনেকের চেয়ে ভালো করেই বেঁচেছিল আমার ভাইটি। বিষয়বৈভবে নয়, কী হনুরে-জাতীয় ছ্যাবলা আত্মÄগরিমাতে নয়, হাস্যমুখরতায়, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ উচ্ছলতায়, প্রাণপ্রাচুর্যে। ওকে যারা জানত তারা একবাক্যে বলবে, হাবিবুর রহমানের মতো রসিক লোক সংসারে দ্বিতীয়টি নেই। ওর সঙ্গে এককাপ চা খাওয়া মানে হাসির চোটে পেটে খিল ধরানো। ওর সম্বন্ধে লোকে বলত, হাবিবদার গল্প শোনার পর তিন দিন পরেও হাসি থামানো যেত না।
আমরা একসময় পাঁচ ভাই, চার বোন ছিলাম। আমিই সবার বড়। এখন সেটা চার ভাই আর তিন বোনেতে নেমেছে। সংসারে ন্যায়বিচার বলে যদি কিছু থাকত, তাহলে আমারই যাওয়ার কথা ছিল সবার আগে। আগে এলে আগে যাবে, তাই না? এই তো নিয়ম। কিন্তু এটা মানুষের নিয়ম, প্রকৃতির নয়। প্রকৃতি ওসবের ধার ধারে না। যখন যাকে ইচ্ছে তুলে নিয়ে যায়। আমার ভাইবোনেরা বলে, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। এটা যে আল্লাহরই ইচ্ছা সে খবর তোমাদের কে দিল? আর যদি হয়েও থাকে তাহলে সেই ইচ্ছার কাছে নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, প্রেম-ভালোবাসা সব অবলীলায় সঁপে দিতে হবে—সে-যুক্তি কিছুতেই ঢোকে না আমার মাথায়।
ছোটবেলার অনেক স্মৃতিই মন থেকে মুছে গেছে—কতগুলো বড় বড় ঘটনা ছাড়া। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধটা মনে আছে। জাপানিদের বোমারু বিমান আকাশে ঘোরাফেরা করতে আসার আভাস পেলেই শিঙ্গা বেজে উঠত রাতের বেলা, আর আমরা ভাইবোনেরা ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে চলে যেতাম চৌকির নিচে, সেটা মনে আছে। একদিকে শত্রুপক্ষের বোমার ভয়, আরেকদিকে চৌকির তলায় সবাই মিলে গোঁজাগুঁজি করে লুকিয়ে থাকার মজা, বেশ লাগত সে সময়। মনে আছে ’৪৩ সালের মন্বন্তরের কথা। মনে আছে প্রচণ্ড দারিদ্র্যের কথা, ক্ষুধার কথা, রাস্তার মরা কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে অনাহারে-অর্ধাহারে কঙ্কালসার হয়ে পড়ে থাকা মানুষগুলোর কথা। সেগুলো ভোলার নয়। সারাজীবন গেঁথে থাকে মনে। জয়নুল আবেদিনের স্কেচের মতো। অমর্ত্য সেন লিখেছিলেন সেই দুর্ভিক্ষের কথা। তাঁর পরবর্তী জীবনের চিন্তাভাবনার জগতে কতটা রসদ জুগিয়েছিল সে সব ভয়াবহ দৃশ্য। আমার নিজেরও স্মৃতির বেদিমূলে সেই মরা বিড়ালগুলোর ছবি, সেই মরা মানুষগুলোর ছবি এখনো, এই এতকাল পরেও, অনির্বাণ শিখা হয়ে জ্বলছে।
মনে আছে ১৯৩৯ সাল। একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শুনি, আমার একটি নতুন ভাই এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহর কাছ থেকে কীভাবে আসে? ডাকপিয়ন যেভাবে চিঠি বিলি করে, না ফেরিওয়ালা যেভাবে শাকসবজি নিয়ে আসে সেভাবে। সেটি জিজ্ঞেস করার বয়স বা বুদ্ধি তখনো হয়নি। মায়ের প্রসূতিঘরে গিয়ে দেখি, একটুকরো লাল মাংসপিণ্ড। জীবন্ত, ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদছে। আমি ওর লাল শরীর দেখে মাকে জিজ্ঞেস করি, মা, ভাই এত লাল কেন। মা তাঁর ক্লান্ত মুখটিতে একটু মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বললেন, তোর ভাই খুব ফর্সা হবে, তাই। আয়, কাছে আয়, ভাইয়ের গায়ে আস্তে করে হাত বুলিয়ে দে। আমি ভয়ে ভয়ে, আস্তে, অতি আস্তে, যেমন করে মানুষ কোরআন শরিফে হাত বোলায়, তেমনি করে ওর গা ছুঁলাম। মা, ওর গা এত গরম কেন? ওর বুক এমন ধুকধুক করে কেন? হায়রে দুর্বোধ বালক।
তখন আমরা দুই ভাই, দুই বোন। এক বছর দুই বছর অন্তর আমাদের জন্ম। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় কীভাবে সেই তালিমটা আমাদের পেতে হয়েছিল শৈশব থেকেই। তবুও সংসারে দুটি সুস্থ সবল ছেলে পেয়ে বাবা-মা দুজনই খুশি। করুণাময়ের প্রতি পরম কৃতজ্ঞ। এক হিসেবে আমাকে তাঁরা দেখতেন ভবিষ্যতের ব্যাংক ব্যালান্সের মতো করে, আর আমার এই সদ্যোজাত ভাইটি ছিল অনেকটা ইনস্যুরেন্স পলিসি। গরিব কেরানির ছেলেদের এ ছাড়া আর কোনো ভবিষ্যৎ থাকার কথা ছিল না সে যুগে। সে কারণে বাড়িতে সব ভাইবোনের চেয়ে বাবা-মায়ের বিশেষ খাতিরের দৃষ্টিটা ছিল আমারই ওপর। আমার ভাগে পুরো একগ্লাস দুধ, আর ওরা পাবে অর্ধেক। মাছের মুড়োটা আমার, লেজটা ওদের। ঈদের নতুন জামাকাপড় ওরা পাক বা না পাক আমি পেতাম ঠিকই। বড় ছেলের প্রতি এই পক্ষপাতিত্বের দৃষ্টি সংসারের অভাব-অনটনের চিত্রটাই তীক্ষ্ণভাবে ফুটিয়ে তোলে কেবল, আর কিছু নয়।
সংখ্যাটি বাড়তে বাড়তে শেষ পর্যন্ত নয়েতে গিয়ে পৌঁছায়। সব শেষের বোনটি, মায়ের পেটঝরা সন্তান, ওর জন্ম হয় বাবা যখন প্রায় অবসর নেওয়ার বয়সে পৌঁছেছেন। সৌভাগ্যবশত আমরা ভাইবোনগুলো লেখাপড়ায় একেবারে গাধা ছিলাম না কেউই। দুজন তো রীতিমতো উচ্চমানের প্রতিভার কাতারে। আমার এই ‘লাল’ ভাইটি এবং সবচেয়ে ছোট পঞ্চম ভাইটি, মাহফুজ। আমি নেহাত খারাপ ছিলাম তা নয়। ছোটবেলায় এতটা দুধকলা দিয়ে পোষার পর গাধা ছাত্র হওয়ার উপায়ই বা কী ছিল। তবে ওদের মতো তুখোড় আমি কখনোই ছিলাম না। হাবিবের মাথার সঙ্গে আমার কোনো তুলনাই হয় না। অবিশ্বাস্য ধীশক্তিসম্পন্ন লোক ছিল একটি। বইয়ের পাতায় একবার চোখ বোলালেই হলো, সব ছাপ মেরে থাকল মাথায়। স্কুলের পাঠ্যবইয়ের প্রতি ওর তেমন মনোযোগ ছিল না। মনোযোগ ছিল বাইরের বইয়ের প্রতি—ইংরেজি-বাংলা উভয় ভাষাতেই। বাংলায় রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নজরুল, বুদ্ধদেব বসু, বঙ্কিমচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল সবই তার মোটামুটি পড়া ছিল কলেজে থাকাকালেই। ওদিকে বিদেশি সাহিত্যে কে কবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সবগুলো নাম সে গড়গড় করে মুখস্থ বলে যেতে পারত। ওর পড়ার টেবিলে পাঠ্যবইয়ের বদলে বরং বেশি দেখা যেত ইবসেন আর ন্যুট হ্যামসনের বই, রেমার্ক আর ব্যালসাকের বই, সমারসেট মম আর রঁমা রোঁলার বই। ওর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাধ্য ছিল না আমার।
আমরা সবাই মোটামুটিভাবে ‘ভালো ছাত্র’ ছিলাম বলে রক্ষে, নইলে হয়তো আমাদের স্কুলে ভর্তি হওয়াই কষ্টকর হয়ে যেত। আমাদের পাঁচ ভাইয়ের সবাই ঢাকার সরকারি মুসলিম বয়েজ হাইস্কুল থেকে পাস করা। সেকালের সবচেয়ে ভালো স্কুলগুলোর মধ্যে ছিল সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, ছিল ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, পগোজ আর নবকুমার স্কুল (অমর্ত্য সেন ছোটবেলায় ওই স্কুলে পড়তেন) ও আর্মানিটোলা স্কুল। এগুলোর কোনোটাতেই আমাদের ভর্তি করানোর মতো সামর্থ্য ছিল না আমার বাবার। একমাত্র মুসলিম হাইস্কুলই ছিল আমাদের সাধ্যের মধ্যে, যেখানে বাসা থেকে হেঁটে যাওয়া যেত অনায়াসে। মুসলিম হাই স্কুলে আমাদের বেতন দিতে হত না, অপেক্ষাকৃত ‘মেধাবী’ হওয়ার কারণে। সেকালে আমাদের দেশটি স্বাধীন ছিল না, এমনকি পাকিস্তানও হয়নি তখন। তা সত্ত্বেও আমরা প্রায় বিনা বেতনে ক্লাস থ্রি থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত লেখাপড়া করে এসেছি। বড় ছেলে হওয়াতে আমার কিছু বাড়তি সুবিধা ছিল, এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে ওঠার পর আমার জন্য নতুন বই কিনে দেওয়া হতো। নতুন বইয়ের গন্ধ আর ছোঁয়ার একটা অন্য রকম আকর্ষণ ছিল, যা আমার ছোট ভাইগুলোর কারোরই ভাগ্যে ঘটেনি, এমনকি হাবিবেরও না, এত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও। ওদের কপালে ছিল পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে সস্তায় কেনা ছেঁড়া-ময়লা বই বা আমারই ব্যবহৃত বইগুলো। আমার এ ভাইটি অনেক সময় বই ছাড়াই কাজ চালিয়ে দিত। সেই যে বললাম, একবার চোখ বোলালেই যথেষ্ট ওর জন্যে। সেটা সে অনায়াসে করে ফেলতে পারত কোনো বন্ধুর বই ধার করে, নয়তো লাইব্রেরিতে গিয়ে। এমনই তুখোড় ছাত্র ছিল সে।
সেকালে কোচিং স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম, ও-লেভেল, এ-লেভেল, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, এসব গালভরা শব্দ আমাদের জানা ছিল না। সিনিয়র কেমব্রিজ, জুনিয়র কেমব্রিজ এসবের অর্থ কী? কেমব্রিজ তো শুনেছি ফিরিঙ্গির দেশে, তার সঙ্গে আমাদের গরিব দেশটির কী সম্পর্ক? এগুলো আসলে আমি এখনো বুঝি না ভালো। সত্যি তো, বাংলাদেশে এসবের আমদানি হলো কেমন করে, বা কেন? আমি শুধু এটুকু জানি, আমাদের সেই বেতনহীন গরিবের স্কুলটিতেও আমরা ইংরেজি এবং বাংলা দুটি ভাষাই মোটামুটি ভালো করেই শিখেছি। দুটোর ওপরই সমান জোর দেওয়া হতো। দুটোতেই আমরা ভাষা, ব্যাকরণ, রচনা থেকে শুরু করে কবিতা উপন্যাস পর্যন্ত শিখেছি। আমি বেশ গর্বের সঙ্গেই বলতে পারি, আমার এই পরিণত বয়সে ভাষা দুটির ওপর সামান্য কিছু দখল যদি হয়ে থাকে আমার, তার সবটাই ঢাকার সেই গরিব স্কুল থেকে শেখা। আমার নিজের বেলায় নয় কেবল, অন্য ভাইগুলোর বেলাতেও একই জিনিস ঘটেছে। ওদিকে আমার প্রথম দুটি বোন পড়ত ইডেন গার্লস স্কুলে, শেষের দুটি পাস করেছে কামরুন্নেসা গার্লস হাই থেকে। ও দুটোতেও একই ব্যাপার—ইংরেজি-বাংলা দুটোই শিখতে হতো সমান গুরুত্ব দিয়ে। সেখানেও বেতনের ব্যাপারে, কোনোরকম জোরজবদস্তি ছিল না। অভিভাবকদের সামর্থ্য না থাকলেও তাদের জন্যে থাকত প্রচুর অর্থসাহায্যের ব্যবস্থা।
দেশভাগের সময় হাবিবের বয়স ছিল মাত্র আট। ক্লাস ফোরের ছাত্র। ওর মেধার পরিচয় পরিষ্কার হয়ে উঠছে সবার কাছেই। বরাবরই সে ফার্স্ট হতো, ওকে হার মানায় কার সাধ্য। অথচ এ নিয়ে তার কোনোরকম দেমাগ, মানগরিমা এসবের বিন্দুমাত্র লক্ষণ ছিল না। ওগুলো ছিল ওর চিন্তার বাইরে। যেন এ কোনো ব্যাপারই না—ক্লাসে তো মানুষ ফার্স্টই হয়, তাই না? ওর জন্যে ক্লাসে ফার্স্ট হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক অবস্থা।
এভাবেই চলছিল দিন। বছরের পর বছর। হাবিব আমাদের পরিবারের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। বাবা-মায়ের ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা সব ওকে কেন্দ্র করে। এমন সময় সূচনা হলো এক অপ্রত্যাশিত বিপদের আশঙ্কা। ওর সারা গায়ে, বিশেষ করে মুখে, কী সব লাল লাল গুটিকার মতো দাগ। যেন মশায় কামড়েছে ওকে। বাবা ওকে নিয়ে গেলেন তাঁর এক হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার বন্ধুর কাছে। বন্ধু তাকে ওষুধ দিলেন কিছু—হয়তো নিশ্চিতভাবে না জেনেই সমস্যাটা আসলে কী। কাজ হলো না। চেনাজানা যার যত টোটকা দাওয়াই ছিল জানা সবই ব্যবহার করা হলো। কিন্তু ওর মুখের ফোলা কেবল বেড়েই যাচ্ছিল—বেচারা ভালো করে মুখে পানি ঢালতে পারছিল না। তখন সেই হোমিওপ্যাথি ডাক্তারই সন্দেহ প্রকাশ করলেন যে ঘটনাটা বোধ হয় বেশ গুরুতরই—সম্ভবত কুষ্ঠরোগের প্রাথমিক লক্ষণ। কুষ্ঠরোগ? শব্দটা শোনামাত্র আমাদের গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। এ রোগ কেমন করে ঢুকল আমার সোনার ভাইটার শরীরে?

হোমিওপ্যাথি ডাক্তারটি নিজে খুব বড়কিছু না হলেও কোথায় গেলে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে সেটা জানতেন। বললেন, ডাক্তার নন্দীর কাছে নিয়ে যান। একে তো বড় ডাক্তার, তার ওপর দয়ার সাগর। অভাবী সংসার হলে খুব কম পয়সাই নিতেন তিনি। মাঝে মাঝে একেবারে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। হাবিবকে তাঁর অফিসে নিয়মিতভাবে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। প্রতি মাসে একবার করে নিয়ে যেতাম ওকে। সাতসকালে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতাম, বাসায় ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত। এভাবে ডাক্তার নন্দীর চিকিৎসা চলল বছর খানেক। খুব একটা উন্নতি হচ্ছিল তা নয়, তবে অবনতিটা খানিক থামাতে পেরেছিলেন তিনি। এরই মাঝে এসে গেল ওর ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময়। কিন্তু এই শরীর নিয়ে পরীক্ষার হলে যাবে কীভাবে? অন্য ছেলেরা তো ওর মুখ দেখে ভয়ে পালিয়ে যাবে। অতএব বিশেষ ব্যবস্থা করতে হলো ওর পরীক্ষার—সিক বেড। অর্থাৎ আলাদা একটা ঘরে অন্যান্য রুগ্ণ পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে তাকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে বসতে দেওয়া হলো। এ অবস্থায় কি পরীক্ষা পাস করা চাট্টিখানি কথা? কিন্তু আমার ভাইটি তো সংসারের অন্য ভাইদের মতো নয়—ও কেবল তার নিজেরই মতো। সে শুধু পাসই করেনি পরীক্ষায়, মেধাতালিকাতে প্রথম ১০ জনের ভেতর তার স্থান ছিল বেশ উঁচুতেই।
ডাক্তার নন্দীর চিকিৎসা তেমন কার্যকর না হলেও সৌভাগ্যক্রমে দ্বিতীয় আরেকটি চিকিৎসাতে অলৌকিকভাবে কাজ হয়ে গিয়েছিল—হেকিমি চিকিৎসা। বাবার এক জানাশোনা হেকিম ছিলেন আমাদের সূত্রাপুর পাড়াতেই। তাঁর দেওয়া এক বোতল আচারের মতো দেখতে ওষুধ আশ্চর্যরকমভাবে কাজে লেগে গেল। দুয়েক মাসের মাঝেই আমার ভাইটি আবার সেই ঈষৎ লালচে আভার উজ্জ্বল গৌরবর্ণ নিয়ে ফিরে এল আমাদের মাঝে। সেই হেকিমটির প্রতি কত যে ঋণ আমাদের—বলে শেষ করা যাবে না।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার এ-ভাইটি যদি পশ্চিমের কোনো উন্নত দেশে জন্মগ্রহণ করত, তাহলে একদিন সে বিশ্বদরবারে একটি সম্মানিত নাম নিয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারত। কে জানে, হয়তো কোনো বড় ঐতিহাসিক (ইতিহাস ছিল তার প্রিয় বিষয়), অর্থনীতিশাস্ত্রের জাঁদরেল পণ্ডিত কিংবা ফজলুর রহমান খানের মতো বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি, সত্যজিৎ রায়ের মতো কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাণশিল্পী—কত অসীম অসীম সম্ভাবনা ছিল ওর জীবনে।
দুঃখের বিষয় যে সেগুলোর কোনোটাই তার হয়ে ওঠা হয়নি, যার প্রধান কারণ তার জন্মটাই ছিল ভুল দেশে, ভুল সময়ে, ভুল পরিবারে। তার অভাগা দেশ নিজেরই অন্ন-বস্ত্রের জোগান দিতে নিত্য গলদঘর্ম, সে কেমন করে তাকাবে তার সন্তানের মস্তিষ্কের

ভেতর, কেমন করে তাকে জ্ঞানার্জনের জন্যে পাঠাবে দেশ-বিদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যানিকেতনে, কেমন করে জোগাবে তার বুদ্ধি ও ধীশক্তির সুযোগ্য পুষ্টি। কিন্তু আমার ভাইটির জীবনে স্বদেশের হীনাবস্থা ছাড়াও একটা বড় উপকরণ ছিল যা তার অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল—স্বেচ্ছায় নয়, অজ্ঞতায়, অনবহিততায়, অপরিপক্বতার অর্বাচীনতায়। সেই উপকরণটির মূল উৎস ছিলাম আমি—ওর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। হ্যাঁ আমি, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমার।
একবার নয়, দুবার। মানুষ জীবনে দ্বিতীয় সুযোগটি পায় না সচরাচর, আমি ওর পায়ে দুবার কুড়োল মেরেছিলাম, না জেনে।
ও যখন কলেজ পাস করে (প্রায় একই কৃতিত্বের সঙ্গে) বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকবে ঠিক সে সময় আমাদের পরিবারে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। বাবার অবসরপ্রাপ্তি এবং আমার বিলেতযাত্রা। একটি শুভ, আরেকটিতে সর্বনাশের সংকেত। বাবার যদি ‘উপরি’ রোজগার বলে কিছু থাকত, যা সেকালের কেরানিদের প্রায় সবারই ছিল, তাহলে হয়তো উদ্বেগের কারণ ছিল না তেমন। কিন্তু লোকটা ছিল ভীষণ গোঁয়ার রকমের ‘সৎ’ কেরানি। চাকরিজীবনের প্রথম থেকেই পণ করেছিলেন নিজের বিবেকের সঙ্গে যে কখনো একপয়সা ‘হারামি’ পথে কামাই করবেন না। তারপর পরিবারের লোকসংখ্যা যত বেড়েছে আর্থিক সমস্যা বেড়েছে তার দ্বিগুণ পরিমাণে, কিন্তু এই লোকটার কোনো বিকার নেই তাতে, হারাম ছোঁবেন না জীবিত অবস্থায়—যার পরিণাম আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হয়েছে সারা জীবন (আমাদের বাবা কোনো বিষয়সম্পত্তি রেখে যেতে পারেননি, রেখে গিয়েছিলেন কেবল এই একটি জিনিস: সততা, নিরাপস সততা)। যেহেতু বাবার উপার্জন প্রায় শূন্যতে, এবং আমি দেশের বাইরে ছাত্রাবস্থায়, সেহেতু পারিবারিক দৈনন্দিন জীবনের বাজারখরচের পথটাও একরকম বন্ধ। সে যে কী অকথ্য দুরবস্থাতে কেটেছে আমার বাবা-মা আর ভাইবোনেদের ওই দুটি বছর তার বর্ণনা দিতেও আমার গা হিম হয়ে যায়। আমাদের পারিবারিক জীবনের দুর্ভিক্ষ একবার এসেছিল ’৪৩-এ, দ্বিতীয়বার ’৫৬ আর ’৫৭-তে। প্রথমটির ধাক্কা আমরা সামলাতে পেরেছিলাম কষ্টেসৃষ্টে, কিন্তু দ্বিতীয়টি প্রায় কাত করে ফেলেছিল। ঠিক ওই সময়তেই আমি ভাইটিকে পাঠিয়ে দিলাম ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে, প্রকৌশলী হবে সেই আশাতে। একান্তই গতানুগতিক চিন্তার ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত। প্রকৌশলীদের পাস-করা-মাত্র নিশ্চিত চাকরি, ভালো বেতন, উন্নততর জীবনযাপনের সম্ভাবনা ইত্যাদি। একবারও কিন্তু ভেবে দেখিনি ছেলেটা কীভাবে এতটা পথ হেঁটে যাবে রোজ বাসা থেকে কলেজ পর্যন্ত (রিকশা বা বাসে করে যাবে সে অবস্থা তো ছিল না ওর), ক্লাস করার জন্য যে বইপত্র আর খাতা-কলমের প্রয়োজন হয়, সেগুলোই বা জোগাবে কে। ইঞ্জিনিয়ারদের তো নানারকম যন্ত্রপাতি কিনতে হয়, ওগুলোর কী হবে? সবশেষে আরও একটা বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না—সারা দিন ছেলেটা না খেয়ে থাকবে কেমন করে। বাসায় ফিরতে তো সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার হয়ে যাবে। না, এগুলোর কোনোটাই আমি গোনার মধ্যে রাখিনি। একটু কষ্ট করতেই হয় প্রথম জীবনে এই ছিল আমার চিন্তাধারা। দুই বছর পর আমি যখন পাস করে ফিরে গেলাম দেশে, তখন সঙ্গে করে ওর জন্যে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং রুলার নিয়ে গিয়েছিলাম—ওর জীবনের প্রথম হাতে ধরার মতো রুলার। কিন্তু তত দিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। ভাইটা শেষ পর্যন্ত পেরে উঠল না এতগুলো বাধা একসঙ্গে উতরাতে—পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থান দখল করার পরিবর্তে ওর কপালে এল ‘সেকেন্ড ক্লাস’ ডিগ্রির চূড়ান্ত লজ্জা। ব্যস, আর কি। একবার গায়ে ‘সেকেন্ড’ শব্দটা এঁটে দেওয়া হলে সেটাকে মোচন করার সাধ্য কার। যে ছেলে হতে পারত বিশ্ববিখ্যাত কোনো কৃতিপুরুষ, তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হলো ‘সেকেন্ড ক্লাসের’ দুঃসহ গ্লানি আর অপমান। সব আমারই অদূরদর্শিতার কারণে।
কিন্তু তারপর যে দ্বিতীয় ধাক্কাটা এল তার জীবনে, চাকরিজীবনের প্রাথমিক অবস্থাতে, দুঃখের বিষয় যে সেটিও এল আমারই কাছ থেকে। ১৯৬১ সালে হাবিব যখন ফেঞ্চুগঞ্জের সার কারখানার এক অসার চাকরিতে নিযুক্ত আর আমি বিলেতফেরত অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। তখন কী এক ভূত চেপে বসল আমার মাথায়, সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমার নিজের জীবনের একটু সুখস্বাচ্ছন্দ্য দরকার। সে বছরই আমি বিয়ে করে ফেললাম। বিয়েই করলাম না কেবল, বউ নিয়ে বিদেশেও চলে এলাম পরের বছর। অত্যন্ত স্বার্থপরের মতো শোনাচ্ছে জানি কিন্তু সেটা পুরোপুরি স্বার্থপরতা ছিল কি না, সে প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার বাসনা আর নেই আমার। জীবনের সব রহস্য কখনোই খুলে দেয়া যায় না মানুষের কাছে, খুলে লাভও নেই। শুধু এটুকুই বলব আজকে, আমার মৃত ভাইটিকে লক্ষ করে: এসবের কোনোটাই আমার নিজের ইচ্ছাতে ঘটেনি ভাইটি আমার, নিয়তি আমাকে নিয়ে গেছে সেদিকে। দুঃখ কেবল এ জন্য যে আমি সেদিন বুঝিনি যে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলেকে কখনোই তার নিজের সুখ খুঁজতে হয় না। সবচেয়ে বড় ভুলটি তার বিয়ে করে নিজের জীবন প্রত্যাশা করা। বড় ছেলেকে সব সময় আত্মÄবলি দিতে হয়, যাতে করে ছোটরা এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়, তারা গড়ে নিতে পারে তাদের নিজেদের একটা সুন্দর মুক্ত জীবন। তাদের প্রজন্ম যাতে হয়ে উঠতে পারে পরিবারের সত্যিকার উত্তরসূরি। না, আমি ওদের সে সুযোগটা দিইনি। বরং আত্মÄবলির দায়িত্বটা চাপিয়ে দিয়েছিলাম এই ছোট ভাইটিরই ওপর। সে যে কীভাবে একা একা সবটুকু দায়িত্ব পালন করে গেল বছরের পর বছর, জানব না কোনোদিন, ওকে জিজ্ঞেস করার সাহসটুকুও ছিল না আমার। একদিক থেকে ভালোই হলো। ওকে একদিন কি এক দুস্তর মোহের সন্ধানে বলির কাষ্ঠে চড়িয়ে পালিয়ে গেলাম দূরদেশে। কিন্তু ও বা অন্য কেউই জানতে পেল না আমি সেই বিদেশে বসেও অন্য প্রকারের এক বলিকাষ্ঠে প্রবেশ করেছিলাম একান্ত নীরবে, নিভৃতে।
হাবিবের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাগুলোর কোনোটাই হয়তো সফল হওয়ার সুযোগ পায়নি, কিন্তু ছোটখাটো কৃতিত্বগুলো সে নিজেই তৈরি করে নিতে পেরেছিল—যাকে আমি বলি স্থানীয় কৃতিত্ব। প্রকৌশলের পথ থেকে আস্তে আস্তে সরে গিয়ে প্রশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ে একসময় এবং কেবল নিজের অসামান্য মেধা আর যোগ্যতার বলে ওই পথেরও শেষ মাথা পর্যন্ত পৌঁছুতে সক্ষম হয়। ৫৭ বছর বয়সে যখন তাকে অবসর গ্রহণ করতে হয়, তখন সে ছিল বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদস্থ সচিব। দেশের সাধারণ পরিপ্রেক্ষিতে এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে। কিন্তু আমি জানি এবং সেও নিশ্চয়ই জানত, ওই ক্ষণিকের গৌরবটুকুর জন্য তার জন্ম হয়নি। সেই বৃহত্তর গৌরবগুলোর পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই।
মজার ব্যাপার কি জানেন? প্রচণ্ডরকম মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও আমার এ-ভাইটি ছিল সবচেয়ে নম্র, বিনয়ী, ভদ্র শান্তশিষ্ট। দারুণ রসবোধ ছিল তার অতি অল্পবয়স থেকেই। ও ছিল আমাদের পরিবারের সত্যিকার লক্ষ্মী ছেলে। ওকে আমি কখনো রাগ করতে দেখিনি কারও সঙ্গে, কখনো মন খারাপ করে বসে থাকেনি কোথাও, কাঁদতে দেখিনি, নালিশ করতে শুনিনি কারও বিরুদ্ধে। অথচ বাবার বকাবাজির সিংহভাগটা যেন ওরই জন্য বরাদ্দ ছিল। তার দুটি কারণ। এক. ওকে সাধারণত পড়ার টেবিলে বসে পাঠ্যবই হাতে নিতে দেখা যেত না। বেচারার খুব একটা দোষও ছিল না, বসে পড়ার মতো আসলে কোনো টেবিলই ছিল না ওর। সারা বাড়িতে একটিমাত্র টেবিল। তাও বড় ছেলে আর বড় দুটি মেয়ের দখলে প্রায় সব সময়। দ্বিতীয় কারণ, ও নামাজ পড়ত না। বাবা-মা দুজনই রোজ একবার করে ঝাড়তেন আমাদের সবাইকে—হাসরের দিনে কী সব সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ইত্যাদি নিয়ে। তাতে কাজ হতো কিছুটা—আমি এবং আমার অন্য ভাইবোনগুলো অন্তত বাবাকে ঠান্ডা রাখার খাতিরে নামাজের সময় হলে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়তাম, কিন্ত হাবিবকে ধারেকাছে দেখা যেত না। সেদিক থেকে ওর মতো ঘাড়ত্যাড়া ছেলে কোথাও ছিল না। অথচ এ নিয়ে কোনোরকম উচ্চবাচ্য করা, তর্কবিতর্ক করা, গজগজ করতে থাকা মনে মনে, ওসবও ছিল না তার চরিত্রে। মানে একেবারে নির্বিকার। সাক্ষাৎ বুদ্ধদেব—নিজের ধ্যানে নিজেই মগ্ন। এ এক আশ্চর্য ছেলে ছিল আমাদের বাড়িতে। ওর ওপর এত অন্যায় করা হলো জীবনভর, বড়দের এতটা ভুল সিদ্ধান্তের শাস্তি ভোগ করতে হলো ওকে, অথচ এ নিয়ে কি সামান্যতম ক্ষোভ-দুঃখ ছিল তার মনে? কোনো মান-অভিমান? অভিযোগ? ছিল কি না তা আমি হলফ করে বলতে পারব না, অন্তত আমি নিজে কখনোই তার কোনোরকম আভাস পাইনি। ওর অভিধানে বোধ ‘নালিশ’ শব্দটারই উল্লেখ ছিল না। সব সময় হাসিখুশি, আনন্দোচ্ছল, প্রাণোদ্দীপ্ত। যে লোক হাসতে পারে ওর মতো করে, আবার হাসাতেও পারে অন্যদের, তার আবার নালিশের কী প্রয়োজন?
গত ২০১৩ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে হঠাৎ ফোন এল গভীর রাতে। গভীর রাতের ফোন বড় নিষ্ঠুর হয় জানি। ফোন ধরে শুনি আমার বোনের মেয়েটা-অন্তন। শান্ত গলায় দিল সেই মর্মান্তিক খবরটি—হাবিবমামা আর নেই। জানতাম চলে যাবে শিগগিরই। পুরো দুটি বছর লোকটা যুদ্ধ করে গেল মৃত্যুর সঙ্গে। এ বড় শক্ত রোগ—লুকেমিয়া। একবার কারও শরীরে চড়াও হলে তার নিস্তার নেই—খ্যাপা হাঙরের মতো মরণকামড় বসিয়ে শুষে নেবে শেষ রক্তবিন্দুটি। সেই কামড় থেকে ছাড়া পাওয়ার সাধ্য নেই কারোরই। দুটি বছর ধরে তার পাশে বসে থেকেছে ওর বউটা—কী যে দারুণ একটা লক্ষ্মী মেয়ে এসেছিল আমাদের পরিবারে, আমার ভাইটির জীবনের সব অপূর্ণতাকে সে ভরে রাখতে পেরেছিল, অনেক বেদনাকে ঢেকে রাখতে পেরেছিল এতগুলো বছর, তার প্রেম দিয়ে, তার অকৃপণ ভালোবাসা আর সেবাযত্ন দিয়ে, আশ্রয় দিতে পেরেছিল ওর বিপদের সময়, ওর জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু, সহযাত্রী, সহধর্মিণী। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ওরা দুজনই হঠাৎ করে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল, দুজনই মক্কায় গেল দুই-দুবার। ইরাকের বড়পীরের দরগায় গেল পরম ভক্তিভরে। আমার ভাইটি একসময় একেবারেই ধর্মের পথে ছিল না, আবার যখন পথ ঘুরিয়ে ভিন্ন পথে শুরু হয় তার চলা, তখনো ঠিক একই নিষ্ঠার সঙ্গে। জীবনের কোনোকিছুতেই তার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না—যা কিছু করেছে জীবনে সবটাতেই ছিল পরম নিষ্ঠা, প্রশ্নাতীত সততা, আপ্রাণ প্রচেষ্টা।
মিনু, আমার এই নিদারুণভাবে একাকী হয়ে পড়া ভাতৃবধূটি, সেদিন বলল আমাকে, দাদা, আমি এ বাড়িতে থাকব কেমন করে? সবকিছুতেই তো দেখছি ওর হাতের ছাপ, পায়ের ছাপ, আঙুলের ছাপ। কিন্তু সে কোথায়? আমি একা থাকব কেমন করে বলে দেবেন দয়া করে? না বোন, আমার বলার সাধ্য নেই তুমি কেমন করে থাকবে ও বাড়িতে। তোমাকেই পেতে হবে তার সন্ধান, যেমন করে পায় পৃথিবীর প্রতিটি প্রেমিক, প্রতিটি হঠাৎ করে একলা-হয়ে-যাওয়া সঙ্গী। ওদের তিনটে ছেলে: বনি, রনি আর অনি। সোনার টুকরা ছেলেগুলো। লব্ধপ্রতিষ্ঠ তাদের নিজেদের জীবনে। বড়টি বনি, তার অপরূপা বউ সোমা, আর তাদের দুটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে ঢাকাতেই। ভাগ্যিস। নইলে মিনু তো একেবারে মহাসাগরে ভেসে যেত। মেজো ছেলে রনি থাকে লস অ্যাঞ্জেলেসে। গুণী ও রূপসী স্ত্রী চৈতি আর ওদের শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মতো দেখতে দুটি মেয়ে নিয়ে। সুখী পরিবার সবারই। ছোটটি বিয়ে করল এই তো সেদিন। বড় শখ ছিল হাবিবের বউটিকে নিয়ে অনি দেশে যাবে ডিসেম্বরে। সঙ্গে সঙ্গে আমিও যাব, সবাই মিলে হাসিকান্নার মধ্য দিয়ে ওর লুকেমিয়ার কথা ভুলে থাকবার ভান করব, কিন্তু বিধাতা ওকে সে সময়টুকু দেননি।
ফোনে কথা হয়েছিল ওর বড় ছেলে বনির সঙ্গে। নিষ্পাপ গলায় অতি সহজেই বলেছিল আমাকে: চাচা, আব্বুকে আমি রোজই দেখতে যাই। গাড়ি করে যেতে হয় না, আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটাপথেরই মধ্যে। আগের মতো এখন আর যানজটের সমস্যা নেই।
হাবিবের মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমি কাঁদিনি। কিন্তু বনির রোজ বাবাকে দেখতে যাওয়ার কথা শুনে আর বেঁধে রাখতে পারিনি নিজেকে। যেখানেই থাকিস ভাই, যদি পারিস আমাকে ক্ষমা করে দিস।
মীজান রহমান
অটোয়া, কানাডা