স্বাধীনতার পরবশীকরণ

লেখক
লেখক

একসময় বিদেশে রাস্তায় দেশি মুখ দেখে অনুমানে বলে দিতে পারতাম তিনি বাংলাদেশি। কীভাবে পারতাম, জানি না। সম্ভবত আমাদের চেহারায় এক প্রকার গ্রাম্যতা আছে, যা সহজেই ফাঁস করে দেয় আমাদের ভৌগোলিক পরিচয়টি। গায়ের রং আর উচ্চতায় হয়তো পূর্ব ভারতের অন্যদের চেয়ে খুব আলাদা নই আমরা। কিন্তু মুখ, হাঁটার ভঙ্গি, একটু অনির্দিষ্ট দৃষ্টি, উঠতে-বসতে খানিক দ্বিধাগ্রস্ততা, এগুলোতেই বোধ হয় আমরা একটু স্বতন্ত্র।
মাঝে মাঝে এমন হতো, কাউকে বাংলাদেশি বলে মনে হলে অচেনা সত্ত্বেও আমি তাঁর সঙ্গে সোজা বাংলা বলতে শুরু করতাম। আন্দাজে ভুল হয়ে গেলে ভদ্রলোক হয়তো ভ্যাবাচেকা হয়ে বলতেন, ‘আই বেগ ইওর পার্ডন।’ তখন আমিও ধরা পড়া চোরের মতো কাচুমাচু হয়ে বলতাম, ‘আই অ্যাম সরি, মাই মিসটেক।’ আর লেগে গেলে ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলতেন, ‘কী করে জানলেন আমি বাঙালি?’ হেসে জবাব দিতাম, ‘কেবল বাঙালি নন, আপনি বাংলাদেশি বাঙালি সেটা আপনার চেহারায় লেখা আছে, জানেন? যেমন আছে আমার।’ ভদ্রলোক খুশি হবেন নাকি নারাজ হবেন, বুঝতে না পেরে জোর করে একটা হাসি টানবার চেষ্টা করতেন মুখে।
ওই অপ্রস্তুত সময়টুকু কেটে যাওয়ার পর অবশ্য আমাদের মধ্যে একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে খুব সময় লাগেনি। আমরা বাংলাদেশিরা কারও সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ জুড়ে দিই না সচরাচর। তবে একবার আলাপ হয়ে গেলে তাঁকে বাড়িতে এনে মোরগপোলাও আর মিঠাইমণ্ডা খাইয়ে অতি যত্নসহকারে আপ্যায়ন করতেও দ্বিধা করি না। এ গুণটুকু আমাদের আছে, সেটা হয়তো কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।
কিন্তু আজকাল আর অত সহজে আন্দাজ করে উঠতে পারি না। আমার অনুমানশক্তি চলে যাচ্ছে বলে হয়তো ততটা নয়, যতটা আমার দেশি ভাইদের লেবাস বদলাতে শুরু করার কারণে। এখন রাস্তাঘাটে কিছু কিছু বাঙালিকে দেখে কিছুতেই বোঝা যায় না, তিনি বাংলাদেশি না কোনো আরবি তেলমোটা শেখ সাহেব। আগে বাংলাদেশি পুরুষদের গায়ে আরবি আলখাল্লা দেখিনি কখনো। এখন দেখতে শুরু করেছি। ঢাকায় নয়, টরন্টো-মন্ট্রিয়ল-নিউইয়র্কের বাঙালিপ্রধান পাড়াগুলোতে। আগে লম্বা দাড়িওয়ালা খুব কমই দেখা যেত বিদেশের রাস্তাঘাটে। এখন প্রায়ই দেখা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ‘দাড়ি’ শব্দটি বাংলাতে সম্ভবত ক্লীবলিঙ্গ, যা স্বাভাবিক, কিন্তু ফরাসি আর হিন্দি ভাষায় এটি স্ত্রীলিঙ্গ! তথ্যটি আমি সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রাষ্ট্রভাষা’ লেখাটি থেকে সংগ্রহ করেছি। যা হোক, এ পরিবর্তনের ধারাটি প্রথম শুরু হয়, আমার যত দূর মনে পড়ে, নয়-এগারোর পর। পরিবর্তনটা কেবল পুরুষদেরই নয়, মেয়েদেরও। ষাটের দশক থেকে গত শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত আমি কানাডা-আমেরিকার রাস্তাঘাটে কোনো হিজাবপরা বাংলাদেশি মেয়ে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আজকাল হিজাব প্রায় ঘরে ঘরে। বয়স্কারাই নন কেবল, অল্প বয়সের মেয়েরাও। এখন এমনও শুনেছি যে, ‘অল্পবয়সী’ মেয়েরাই তাদের মায়েদের হিজাব পরতে বাধ্য করছে। যে মায়েরা জীবনেও কোনোদিন হিজাব বা এ-জাতীয় কোনো ধর্মীয় পোশাক-পরিচ্ছদ পরে অভ্যস্ত ছিলেন না। জানি, হিজাব হলো মুসলমান নারীদের শালীনতা প্রকাশের এক ধরনের বাহ্যিক বাহন। যদিও আজকাল এমন সব বাহারি হিজাব দেখা যাচ্ছে মেয়েদের মাথায়, যাতে পুরুষের ‘কুদৃষ্টি’ নিবৃত্ত থাকার পরিবর্তে বরং আকৃষ্ট হওয়ারই সম্ভাবনা তৈরি হয় বলে মনে হয় মাঝে মাঝে। অথবা সেটা আমারই বোঝার ভুল।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেছি, ধর্মপ্রাণ স্বামীরা তাঁদের স্ত্রীদের মস্তক আবৃত করেই তৃপ্ত হচ্ছেন না, অঙ্গাবরণ পরিধানের ব্যাপারেও যত্নবান হয়ে উঠছেন। অর্থাৎ নিকাব বা বোরখা। এগুলোর কোনোটিই আমাদের দেশের গতানুগতিক পোশাকের অন্তর্গত ছিল না। গ্রামেগঞ্জের অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত পরিবারে, হয়তো শহর বন্দরেও কেউ কেউ বোরকা পরতেন, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য বা পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো ব্যাপকভাবে ছিল না মোটেও। সেটা ব্রিটিশ আমলের কথা। পাকিস্তানের সময়ও হিজাব বা বোরকা-নিকাব কোনোটিই খুব বেশি দেখা যেত না।
কিন্তু এখন ব্রিটিশও নেই, পাকিস্তানি পাঞ্জাবি শাসনও নেই। এখন আমরা স্বাধীন জাতি, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান-দেওয়া, অনেক রক্তঝরা অশ্রু দিয়ে স্বাধীনতা আদায় করে নেওয়া, ধর্মনিরপেক্ষতার দৃঢ় শপথ গ্রহণ করা আত্মপ্রত্যয়ী জাতি। অথচ, কি এক আশ্চর্য অজ্ঞেয় ও বোধাতীত কারণে আজকে আমাদের দেশের মেয়েরা; মা-মেয়ে, নানি-দাদি-খালা-ফুফুনির্বিশেষে হিজাব পরতে শুরু করেছে। অনেকে বোরকা-নিকাবও। শুনেছি, এটা তাঁরা স্বামী বা শাশুড়ির তাড়া খেয়েই পরছেন তা নয়, নিজেদেরই ইচ্ছাতে, ধর্মের অঙ্গ হিসেবে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাঙালি পুরুষ যখন আরব দেশের আলখাল্লা পরেন সেটা পুরোপুরি ধর্মীয় কারণে। তাদের মনে নিশ্চয়ই এমন একটা ধারণা গাঁট হয়ে বসেছে যে, যতই আরবদের মতো পোশাক আশাক পরিধান করা যায়, ততই তাদের মুসলমানিত্বটি পাকাপোক্তভাবে প্রকাশ পায়। তাঁরা বোধ হয় জানেন না যে, আরবরা ইসলামের অনেক আগে থেকেই এ পোশাক পরতেন এবং সেটা ধর্মের বিজ্ঞপ্তি হিসেবে হয়, আবহাওয়ার কারণে। মরুভূমির তাপমাত্রা দিনের বেলায় সাধারণত ৫০ থেকে ৫৫ ডিগ্রির মধ্যে ওঠা-নামা করে। এক ফোঁটা বৃষ্টি হয় না মাসের পর মাস। ওই আবহাওয়াতে সাদা রঙের লম্বা জোব্বাজাব্বা পোশাক পরে তারা সেই তীব্র তাপের তোপ থেকে কিছুটা রেহাই পান। সাদা রঙের ধর্মই হলো সূর্যালোককে বিকিরণ করা। আরব পুরুষেরা মাথায় কাফি পরেন, তা-ও ঠিক একই কারণে। প্রত্যেক দেশেরই নিয়ম তা-ই। মানুষ পোশাক পরে সেখানকার জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে। কোনো মতবাদ প্রচার করার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। সুতরাং আমার দেশি ভাইদের আরবি পোশাক পরে মুসলমানিত্ব প্রচার করার পরিবর্তে বরং তাদের মানসিক বশ্যতা ও বৈকল্যই প্রচার করছেন বেশি। বিশেষ করে যারা কানাডা-আমেরিকাতে বসেই করছেন সে কাজ।
তাহলে বলুন দেখি আমি কেমন করে আগের মতো নিভু‌র্লভাবে বলে দিতে পারব তাঁরা বাঙালি কি না। আমি অবাক হব না যদি অচিরেই আমাদের বাঙালি শেখ সাহেবরা আরব পুরুষদের মতো মাথায় ‘কাফি’ পরতে শুরু করেন, ইসলামের আরও একটি পবিত্র প্রতীক হিসেবে। যদিও আদত কথাটা হলো যে আরবেরা যে কারণে আলখাল্লা পরেন, ঠিক সে কারণেই কাফি পরেন। কাফিটা পরা হয় প্রধানত রোদের তাপ থেকে মাথার চাঁদিটা রক্ষা করার জন্য। আবার যখন বালুর ঝড় ওঠে মরুভূমিতে তখন যেন কাফির গিঁট খুলে নাক-মুখ-কান ঢেকে রাখা যায়। এর সঙ্গে ইসলাম বা খ্রিষ্টধর্মের কোনো সম্পর্কই নেই। কিন্তু সে কথা আমাদের স্বদেশি আরবদের বলে বোঝানোর চেষ্টা বৃথা।
এটা সত্য যে বাংলাদেশের ইসলাম আর আরব দেশের ইসলাম ঠিক এক নয়। হাজার শুকর তার জন্যে। আরবি ইসলাম অনুসরণ করতে গেলে হয়তো আমরাও সামান্য চুরির অপরাধে হাত কাটা শুরু করতাম। খুনের অপরাধে তরবারি দিয়ে গলা কাটার হুকুম দেওয়া হতো। আরবের ওয়াহাবি ইসলাম যদি থাকত আমাদের দেশে, তাহলে অবধারিতভাবে আমাদের মেয়েদেরও মানহত্যার একটা ব্যবস্থা হয়ে যেত। যেমন আছে পাকিস্তানে। আমাদের হাজার কপাল যে পাকিস্তানের ২৪ বছরের রাজত্বকালে এই কুৎসিৎ জিনিসটি বাংলাদেশে আমদানি করার সুযোগ হয়নি। তার প্রধান কারণ এই নয় যে পাকিস্তানি সমাজ আমাদের মতোই অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী মুসলমান। না, তারা মোটেও তা নয়। তবে সৌভাগ্যবশত জেনারেল জিয়াউল হক নামক এক উগ্র মতবাদের শাসনকর্তার রাজত্বকাল শুরু হওয়ার আগেই আমরা ওদের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম।
অবিভক্ত বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রথম প্রবেশ ঘটে ১১৯২ সালে, মোহম্মদ ঘোরির আক্রমণের সময়। এর আগে অবশ্য আরব বণিকেরা বাণিজ্য উপলক্ষে অষ্টম শতাব্দীর শেষদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশের উপকূলীয় জায়গাগুলোতে যাওয়া-আসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেটা ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ছিল না, নেহাতই বাণিজ্যিক স্বার্থে। তবে ধর্ম প্রচার শুরু হয় এবং বেশ ব্যাপকভাবেই তার স্বল্পকাল পরে যখন বাংলা-বিহার অঞ্চলটিতে বখতিয়ার খলজির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা সেই ছোটকাল থেকেই শুনে এসেছি মা-খালাদের মুখে, তিনি কেমন করে মাত্র ১৭ জন বীর মুসলমান যোদ্ধা সহকারে বাংলা জয় করে ইসলামের জয়পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তাঁর বঙ্গবিজয়ের অব্যবহিত পরই তুরস্ক, ইরান আর আফগানিস্তান থেকে বহু সুফি মতবাদের সাধুপুরুষ এখানে এসে সুফি ইসলাম অর্থাৎ আরবি ইসলামের চেয়ে হাজার গুণে বেশি কোমল ও সহনশীল ধর্ম প্রচার করতে থাকলেন। বখতিয়ার খিলজির কিংবদন্তীয় বীরত্ব কাহিনি আরও স্মরণীয় হয়ে থাকে বিখ্যাত বাংলাদেশি কবি আল-মাহমুদের নব্বই দশকে লিখিত বক্তিয়ারের ঘোড়া বইতে।
তবে আমরা, বাঙালি মুসলমানরা, যা বিশ্বাস করতে চাই না সেটা হলো যে, এই একই লোক ইতিহাসে বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল পাঠাগার অগ্নিদগ্ধ করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য। যা-ই হোক, এটা অনস্বীকার্য যে, তাঁর সময়ই স্থানীয় বৌদ্ধ-হিন্দুদের ব্যাপক ধর্মান্তর হতে থাকে ইসলাম ধর্মে। এবং সেটা বলপূর্বক হয়নি, হয়েছিল সুফিদের চারিত্রিক মাধুর্যেরই আকর্ষণে। তবে ইসলাম ধর্মের বিপুল জনপ্রিয়তার পেছনে

সবচেয়ে বড় অবদান বোধ হয় ছিল হজরত শাহজালালের। যাঁর নাম জানে না এমন লোক বাংলাদেশ জুড়ে একটিও পাওয়া যাবে না। এই মহৎপ্রাণ মানুষটির জন্ম ১২৭১ সালে, সম্ভবত তুরস্কের কোনো এক ছোট শহরে। তাঁর বাবা ছিল অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ একজন আলেম গোছের। সুফি কবি জালালুদ্দিন রুমির সমসাময়িক ও ব্যক্তিগত বন্ধু। ছোটবেলায় হজরত শাহজালাল ধর্মশিক্ষার জন্য মক্কায় তাঁর মামার কাছে চলে যান। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর, কথিত আছে, একদিন তাঁর মামা আদর করে কাছে ডেকে বললেন, ‘এই দেখ, আমার হাতে এই মাটির দলা। এটি নিয়ে তুমি এবার ধর্মপ্রচারে বের হয়ে যাও এবং ভারতবর্ষের পথে। তোমার যাত্রা শেষ হবে যখন এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে যেখানকার মাটি বর্ণে-গন্ধে ঠিক এই মাটির মতো। মামার সেই উপদেশ অনুযায়ী উত্তর ভারতের প্রতিটি প্রদেশ ঘুরে শেষ পর্যন্ত সিলেটে এসে দেখলেন মামার সেই মাটির সঙ্গে সিলেটের মাটির রং আর গন্ধ হুবহু মিলে গেছে। এভাবেই স্থাপিত হয়েছিল হজরত শাহজালালের বাকি জীবনের বাসভূমি। তিনি এবং তাঁর মতো আরও অনেক সাধু-সন্ন্যাসীর আধ্যাত্মিক জীবনধারা, তাঁদের ঔদার্য, মহৎ বাণী ও স্থানীয় বৌদ্ধ-হিন্দু-খ্রিষ্টান সংস্কৃতিতে মিলিত হয়ে ধীরে ধীরে আমাদের দেশে একটি উদার, মানবতামুখী ইসলামের ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়, যা দীর্ঘকাল ধরে মোটামুটি অক্ষুণ্ন² ছিল, ব্রিটিশ রাজের কুটিল বিভাজনমূলক শাসননীতি অবলম্বনের আগ পর্যন্ত। আস্তে আস্তে হিন্দু-মুসলমান দুটি সম্প্রদায় পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সর্বদিক থেকে। তারই অন্তিম ফলপ্রসূতে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে একটি প্রাচীন ঐতিহ্যময়, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যময় দেশ বিভক্ত হয়ে তৈরি হয় দুটি ভিন্ন, শত্রুভাবাপন্ন ও বিপরীত মতাবলম্বী দেশ ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশ যে কখনো মানুষের জীবনে শান্তি আর সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে পারে না, এবং কালে কালে সেই অশুভ ধর্মীয় খুঁটি নিজেই দুর্বল হতে শুরু করে, তার প্রমাণ পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের হাড়ে হাড়ে পেতে হয়েছিল একাত্তরের বর্বর গণহত্যায়।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, একাত্তরের ইতিহাস থেকে আমাদের এই জাতিটি কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করতে পারেনি। আবারও আমরা সেই ধর্মের ফাঁদেই পা বাড়িয়ে দিচ্ছি, স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে। এবার আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের তথাকথিত ‘উদার’মনা মুসলমানেরা হজরত শাহজালালের মতো সত্যিকার মহৎ, সাধুপ্রকৃতির সুফি মতবাদ বর্জন করে চরম উগ্রপন্থী, মানবতাবিরোধী, আরব ওয়াহাবি-মওদুদি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি। এ রহস্য বড়ই দুর্বোধ্য আমার কাছে।
ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে একটা পরাস্ত জাতি সচরাচর বিজেতা জাতির আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক বেশভূষা অনুকরণ করে ‘জাতে ওঠা’র চেষ্টা করে। এটা শুধু বাংলায় নয়, পৃথিবীর সব দেশেই ঘটেছে। এক সময় স্পেনের স্থানীয় ইহুদি আর খ্রিষ্টানরা আরবি ভাষা, এমনকি আরবি পোশাক পরিচ্ছদও রপ্ত করে নিচ্ছিল, সেই অষ্টম ও নবম শতাব্দীর ইসলামিক শাসনের যুগে। অবিভক্ত ভারতে মোগল শাসনের সময় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল মোগলদের ভাষা (ফারসি), মোগলদের খাদ্য (পোলাও, কোরমা, পরোটা, বিরিয়ানি ইত্যাদি), কাপড়চোপড় ইত্যাদি আয়ত্ত করে নিতে। তারপর যখন ব্রিটিশদের রাজত্ব শুরু হয়, তখন হিড়িক পড়ে যায় কত দ্রুত ইংরেজদের মতো করে সুট-কোট-টাই-হ্যাট পরে সাহেব সাজা যায়, তাদের ভাষা শেখা যায়, তাদের সাহিত্য, সংগীত, খাবার, পানীয় নিজেদের সংস্কৃতির আওতায় এনে ফেলা যায়। কালে কালে আমরা যারা মুসলমান, তারা হিন্দুদের থেকে একটু পিছিয়ে থাকলেও অচি‌রেই ব্রিটিশ কায়দায় চলাফেরা করতে শিখে ফেলি। শুধু ব্রিটিশই বা বলি কেন, আমরা হিন্দুদেরও অনুকরণ করেছি। হিন্দুদের ধুতি পরে বাবু সেজেছি, আমাদের মেয়েরা হিন্দু মেয়েদের মতো কপালে টিপ দিতে শিখেছে। এবং সেটা স্বাভাবিক। বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের চেয়ে হিন্দুরা ছিল অনেকটাই অগ্রসর। অতএব আমরা যে অনুকরণ করব, সেটা এমন বিচিত্র কিছু নয়। এমনকি দারুণ নিন্দনীয়ও নয় কিছু। শত হলেও এগুলো আমাদের নিজেদের দেশেরই।
কিন্তু আরব? সমগ্র ভারতবর্ষের দুই হাজার বছরের ইতিহাসে আমি তো কোনো আরবি শাসনের খবর পড়িনি। তারা ব্যবসা করতে এসেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। ধর্মপ্রচারও যে করেননি দুচারজন, তা নয়। কিন্তু দলে-বলে কায়েম হয়ে রাজত্ব করতে বসা, যেমনটি তাঁরা করেছিলেন ইউরোপে, সেটা তো কখনোই ঘটেনি আমাদের দেশে। সে যে কত বড় ভাগ্য আমাদের, সেটা বুঝতে হলে মধ্যযুগের ইতিহাস কিছুটা জানতে হবে। এবং এখনো আমরা যা দেখছি নিত্যনিয়ত সৌদি আরব, কুয়েত আর ইয়েমেনে। এমনকি বাড়ির কাছে আল-কায়েদা অধ্যুষিত ইরাক, আফগানিস্তান আর পাকিস্তানে। তাতে ওদের ছবিটা পরিষ্কার ফুটে ওঠা উচিত আমাদের চোখে। কিন্তু কি এক রহস্যময় কারণে তা হয়নি, বরং আমাদের আরব আর আরবিপ্রীতি অবিশ্বাস্য রকম দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। পাকিস্তানের সময় পর্যন্ত আমি কারও মুখে ‘আল্লা হাফেজ’ শুনিনি, শুনেছি ‘খোদা হাফেজ’, কারণ সেভাবেই শিখিয়েছিলেন আমাদের সুফি আলেমরা, পাঠান-মোগল-খলজি শাসকবর্গ। ছোটবেলায় এ দুটোর পার্থক্য বুঝতাম না। কারণ আরবি বা ফারসি কোনোটিই আমি জানতাম না, এখনো জানি না। তবে এই দুয়ের মধ্যে কোথায় ফারাক, সেটা এখন বুঝি। তাদের একটি ইসলামের কোমল ও মানবিক দিকটার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে আমাদের, আর দ্বিতীয়টি করিয়েছে তার কঠোর, নিষ্ঠুর ও উগ্র দিকটার সঙ্গে। কঠোর দিকের সঙ্গে মিতালি করে পাকিস্তান এখন হাঁপিয়ে উঠছে আর কোমল দিকটার সঙ্গে দীর্ঘকাল বসবাস করে আমাদের দেশটি এখনো পর্যন্ত ‘অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী’ রাষ্ট্র বলে আন্তর্জাতিক মহলে আখ্যায়িত হতে পারছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, সেই খ্যাতিটি আর বেশি দিন টিকিয়ে রাখা যাবে না। এবার বোধ হয় ফারসি সুফি-সন্ন্যাসীদের সরিয়ে আরবি, রুক্ষ শ্মশ্রুগুম্ফধর, ‘জিহাদি’রাই আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তার আসন গ্রহণ করতে উদ্যত। এবং সেই পথটা, অজ্ঞাতে আমরাই তৈরি করে দিয়েছি।
বাংলাদেশের সাংবিধানিকভাবে লিপিবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ, যাকে ব্যাপকতর অর্থে ইহজাগতিকতা বা সেক্যুলাজিম বলে আখ্যায়িত করা যায়, তার ললাটে প্রথম তিলক ফোঁটাটির আবির্ভাব বোধহয় দেখা দিয়েছিল ১৯৭৪ সালেই, যখন আমাদের তদানীন্তন সরকার Organization of Islamic Cooperation-এর সঙ্গে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক যেকোনো কারণেই হোক। সেই প্রাথমিক প্রক্রিয়াটি আরও জোরদার হয়ে ওঠে আশির দশকে জেনারেল এরশাদ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করার পর। এ সময় কি আপত্তি জানিয়েছিলেন আমাদের তথাকথিত ‘উদারপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ সহনশীল’ জনসাধারণ? হ্যাঁ, জানিয়েছিলেন, তবে জনসাধারণ বলাটা ঠিক হবে না। লেখাপড়া জানা, স্বাধীনতাপ্রিয়, ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে কম-বেশি মুক্ত ছাত্রছাত্রী, লেখক-শিল্পী-ভাস্কর-স্থপতি-কবি গোছের সৃষ্টিধর্মী ছোট গোষ্ঠীই প্রধানত।
আজকে আমার দেশ সেই ক্রমপতনের শেষ দৃশ্যটা অবলোকন করতে পারছে। আমরা সেই ক্রমিক অথচ সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়ার শেষ অধ্যায়ে প্রায় উপনীত এবং কার্যত আরবের তৈলাক্ত হস্তের পিচ্ছিল মুষ্টিতে আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ। তাই আমরা আরবি পোশাক দেখে নকল করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ি। আরবি শব্দ শুনে অনুকরণ করার জন্য পাগল হয়ে উঠি ‘সোয়াব’-এর আশায়। শব্দটি আরবি না হলেও ক্ষতি নেই। আরবি-আরবি শোনালেই হলো। যেমন ‘হালাকা’। আমি জীবনের শেষ বয়সে এসে কানাডা-আমেরিকার বাংলাদেশিবহুল পাড়ায় আজকাল নিত্যই শুনছি এই শব্দটি। আগে প্রবাসে আমরা বাংলা বর্ষবরণ করতাম বাংলা গান আর নাচের অনুষ্ঠান করে। এখন সেসব প্রায় হয় না বললেই চলে। কারণ, সেগুলো নাকি ‘হিন্দুয়ানি’। এখন হয় ‘হালাকা’। শব্দটার অর্থ কী, জিজ্ঞেস করলে অর্থ কেউ বলতে পারবে না। অর্থটি তার জানা নয়। কেবল এটুকুই তার বিশ্বাস যে, এটি কোনো আরবি শব্দ। মুশকিল হলো যে, এটি আরবি শব্দ নয়, হিব্রু শব্দ। অর্থাৎ মুসলমান জাতির ‘জাতশত্রু’ যে ইহুদি জাতি, তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের ভাষা। এর অর্থ হলো: ইহুদি ধর্মের আইনকানুন! মুসলমানদের যেমন শরিয়া, খ্রিষ্টানদের কানুন, তেমনি রয়েছে ইহুদিদের ‘হালাকা’। আমার কানাডা-আমেরিকার মুসলমান বিজ্ঞজনেরা জেনেশুনে ‘শত্রুপক্ষের’ ধর্মীয় আইনকানুন নিয়ে সময় ব্যয় করবেন, সেটা বিশ্বাস করতে কেন জানি আমার মন সায় দেয় না।
একটা জাতি যখন তার স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়ে পরাধীনতার শিকল পরাতে চায় নিজের পায়ে, তখন তাকে আপনি ‘স্বাধীন’ করবেন কী করে? আর করেই বা লাভ কী? সে তো আবার অন্য কাউকে খুঁজবে শেকল পরার জন্য।
আগেকার পরাধীনতায় অন্তত একটা সান্ত্বনা ছিল। ফারসিভাষী সুফিদের কাছে আমরা উঁচুমানের শিল্পকলা ও সংগীত শিখেছি। ইংরেজদের কাছে শিখেছি ‘আধুনিক’ হওয়া কাকে বলে। কিন্তু এই আরবদের কাছ থেকে আমাদের কী শেখার আছে?
মীজান রহমান
অটোয়া, কানাডা
(১৭ আগস্ট, ২০১৩)