কাইয়ুম ভাই ইজ কাইয়ুম ভাই

কাইয়ুম চৌধুরী (৯ মার্চ ১৯৩২—৩০ নভেম্বর ২০১৪)৷ বর্ণিল জীবন ছিল তাঁর
কাইয়ুম চৌধুরী (৯ মার্চ ১৯৩২—৩০ নভেম্বর ২০১৪)৷ বর্ণিল জীবন ছিল তাঁর

কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৫৯ সালে। আর্ট কলেজে তিনি তখন শিক্ষক ছিলেন। বছর খানেক পরে তিনি বিসিকের চাকরি নিয়ে চলে গেলেন। পরে আবার আমরা সহকর্মীও হলাম। অবজারভার গ্রুপ অব পাবলিকেশনসে চাকরির সুবাদে। তখনই আমাদের কাছাকাছি আসা। তার পর থেকে তো সর্বক্ষেত্রেই তাঁর সঙ্গে ছিলাম। এই যে ষাট দশকের দেশব্যাপী যে আন্দোলন, তার সঙ্গে আমরা জড়িত ছিলাম। সেখানে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি, একসঙ্গে ভেবেছি কী পোস্টার করা যায়, পোস্টারের ভাষা কী হওয়া উচিত, নকশাটা কেমন হবে। সেই সব আন্দোলন কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল। সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল তার সঙ্গে যুক্ত। কাইয়ুম ভাই আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র। কিন্তু এই সব করতে গিয়েই তাঁর সঙ্গে বয়সের দূরত্বটা কমে গেল। আমরা ছিলাম কাছের মানুষ। আমরাও যখন কিছু করতাম বা কিছু জানতে চাইতাম, তখন তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতাম, সহায়তা নিতাম।
কাইয়ুম ভাইয়ের স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ! লেখাপড়া করতেন৷ সে লেখাপড়া ছিল পরিশীলিত। যা পড়তেন, তার ভেতরে চলে যেতেন। কোনো কিছুই তিনি ভাসা ভাসা পড়তেন না। আর গান শোনার কথা না বললেই নয়। এই জিনিসটা আমরা তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি। সংগীতকে ভালোবাসতেন। সংগীত না শুনলে ছবি আঁকা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি ভাবতেন, দুটোই পরস্পরের পরিপূরক। তাঁর তো বাংলাদেশে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগ্রহ রয়েছে গানের রেকর্ডের। এই সংগীতের কারণেই কাইয়ুম স্যার, সফি স্যার (সফিউদ্দীন আহমেদ) আর আমার মধ্যে সম্পৃক্ততা বেড়ে গিয়েছিল। আমি কাইয়ুম স্যারের কাছের একজন হতে পেরেছিলাম।
কাইয়ুম ভাইয়ের মধ্যে কোনো দেখানো ভাব ছিল না। বড় শিল্পী বলেই একধরনের গাম্ভীর্য নিয়ে চলাফেরা করতে হবে, অন্যদের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি করে চলতে হবে—এসব কিছু তাঁর মধ্যে ছিল না। বয়সকে তুচ্ছজ্ঞান করে তিনি একইভাবে সবার সঙ্গে মিশতেন। কাইয়ুম ভাই একজন পরিশীলিত রুচির মানুষ ছিলেন। পোশাকে-আশাকে, চাল-চলনে, কথায়-বার্তায়, চিত্রকলা-প্রচ্ছদ ইত্যাদিসহ সবখানেই রুচির ব্যাপারটা বজায় থাকত। তিনি বইয়ের প্রচ্ছদের, ইলাস্ট্রেশনের, ছবির রুচি পরিবর্তন করে দিয়েছেন। দেশকে নিয়ে অসাধারণ সব ছবি এঁকেছেন! দেশের মানুষ, দেশের প্রকৃতি দেশের জীবজন্তু, দেশের রং—এসব ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয়।
অত্যন্ত রসজ্ঞ, প্রাজ্ঞজন ছিলেন তিনি। রসিকতা করতেন এবং রসিকতা কেউ করলে সেটা তিনি উপভোগও করতেন। আড্ডা পছন্দ করতেন খুব। আমি নিশ্চিত, তাঁর মতো আর কেউ হবে না, সম্ভব নয়। অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। সাংস্কৃতিক মানুষটির মৃত্যু হলো সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই একটি বক্তৃতা দিতে গিয়ে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে একটি সাংস্কৃতিক উৎসবের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হলো। তিনি কাউকে কষ্ট দিলেন না, নিজে কষ্ট পেলেন না। কাইয়ুম ভাই তো কাইয়ুম ভাই-ই। কাইয়ুম ভাই ইজ কাইয়ুম ভাই।