গানটা শুনে আমিও অঝোরে কেঁদেছি

রবিউল হুসাইন
রবিউল হুসাইন

গান, কবিতা আর সুর ছাড়া কি বেঁচে থাকা চলে! আমার মনে হয়, কবিতা হলো মানুষের ভাষা আর সংগীত হচ্ছে নিঃশব্দের ভাষা। গানের প্রতি ভালোবাসা সেই শৈশব থেকেই। শৈশবে একটা গান প্রায়ই শুনতাম। বাড়ির পাশের পথ ধরে ভিক্ষুকেরা হেঁটে যেত আর গাইত। ‘আহারে খোদার বান্দা, কার প্রেমে আছো বান্ধা, একদিন না হবে আন্ধার, ভাবে বোঝা যায়...।’ এই গান গেয়েই ওরা ভিক্ষা করত।

শ্যামল মিত্র
শ্যামল মিত্র

এত দরদ দিয়ে গাইত! কেবলই আকৃষ্ট করে রাখত আমায়। এখনো একান্ত ভালোলাগার মুহূর্তে গানটা একা একাই গুনগুন করি। আগে সিনেমা হলের সামনে, ছবি শুরুর আগে, মাইকে বিভিন্ন আধুনিক গান শোনানো হতো। গান শোনার জন্য প্রায়ই সিনেমা হলের সামনে গিয়ে বসে থাকতাম।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের গান বিশেষভাবে ভালো লাগে। সেই সঙ্গে পছন্দের তালিকায় রয়েছে আব্বাসউদ্দীন, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো এমন কণ্ঠস্বর বোধ হয় পৃথিবীতে একটির বেশি দুটো নেই। এ রকম মাদকতা আর কোথাও পাই না আমি। আরেকজন প্রিয় শিল্পী শ্যামল মিত্র। তাঁর গানের সুরে অনন্যতা—সত্যিই অতুলনীয়। আমি বেড়ে উঠেছি কুষ্টিয়ায়। সেটা ষাটের দশকের কথা। সে সময় কলকাতায় অনুরোধের আসর নামে বেতারে একটা অনুষ্ঠান হতো। যতদূর মনে পড়ে, রোববার সকালে অনুষ্ঠানটি হতো। কলকাতা বেতার আমরা শুনতে পেতাম। দারুণ দারুণ সব গান শুনে রোববারের সকালটা ঝলমলিয়ে উঠত। আমার তো মনে হয়, সে সময়ের কবি, গীতিকার, গায়ক—সবাই সম্মিলিতভাবে সেরা ছিলেন। সোনায় সোহাগা ব্যাপার আর কি! আমার মনে হয়, রবি ঠাকুর আমাদের ডিএনএ। এ জন্যই তাঁর গান শুনলে বাঙালির নাড়ি-নক্ষত্র টের পাওয়া যায়।
এ রকম প্রতিভাবান মানুষ খুব কমই জন্মেছে। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের, জাতীয় জীবনের—সবকিছুতেই আছে তাঁর বাণী। তাই প্রিয় গানের তালিকায় রবীন্দ্রনাথের গানের নাম-ই নিতে হয়। তবে প্রথমেই বলব একটি গানের কথা। ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে তোমায় পাইনি...’ ভীষণ, ভীষণভাবে প্রিয় গানটি আমার কাছে। সম্প্রতি এই প্রিয় গান নিয়ে চমৎকার আর বেদনাময় একটি অভিজ্ঞতা হলো। কিছুদিন আগে আমরা বন্ধুরা মিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। সেখানে গিয়ে হঠাৎ শুনতে পেলাম একজন গাইছে ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে।’ আমার তো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একে তো প্রিয় গান, তার ওপর রবীন্দ্রনাথের বাড়ি দর্শনে এসেছি। খুঁজতে গিয়ে দেখি, একজন বৃদ্ধ তবলা বাজিয়ে গানটি গাইছেন। তিনি অন্ধ। গাইতে গাইতেই তিনি কাঁদছিলেন। কাছে গিয়ে বসলাম। কেন কাঁদছেন, জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ছোটবেলায় ধানের তুষ চোখে পড়েছিল। পরে সেটার খুব ভালো কোনো চিকিৎসা হয়নি। তারপর ধীরে ধীরে তিনি অন্ধ হয়ে যান। তিনি বলেন, এই গানই যেন তাঁর জীবনের দর্শন। আমার প্রিয় একটা গান-অন্য আরেকজনের জীবনের সঙ্গে মিলে গেছে। ঘটনাটা শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। তাঁর পাশে বসে গানটা শুনে আমিও অঝোরে কেঁদেছি। আমার যৌবনে নজরুলের গানও খুব টেনেছে।গান ছাড়াও সুরের প্রতি আমার অন্য ধরনের একটি ভালো লাগা রয়েছে। যন্ত্রসংগীত খুব শুনি। আর শুনি শাস্ত্রীয় সংগীত। সুযোগ পেলেই বিভিন্ন শাস্ত্রীয় সংগীতের আসরে ছুটে যাই। এই সেদিন ঢাকায় শাস্ত্রীয় সংগীতের একটা বড় আয়োজন হয়েছিল। বয়সের তোয়াক্কা না করেই সব কটা রাত জেগেছি। তন্ময় হয়ে শাস্ত্রীয় সংগীত শুনেছি আর প্রাণ জুড়িয়েছি।

l অনুলিখন: সুচিত্রা সরকার